ফিল্ড মার্শাল আইয়ুব খানের আমলের কথা। পাকিস্তানের বাহ্যিক চাকচিক্য, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি নজরকাড়ার মতো। বিপরীতে ভারতে দারিদ্র্যের হার তুলনামূলক বেশি। সে সময় লাহোর সংলগ্ন ওয়াগাহ সীমান্তের জিরো লাইনে দুই দেশের দুই কুকুরের দেখা। দু’টিই সীমান্ত প্রহরীদের চোখ ফাঁকি দিয়ে শত্রু দেশে অনুপ্রবেশের ফাঁকফোকর খুঁজছে। পাকিস্তানের কুকুরটি বেশ মোটাতাজা, ভারতেরটি হাড়-জিরজিরে, অপুষ্ট। পাক কুকুর ভারতের স্বজাতির কাছে জানতে চাইল, তুই ভারতের মতো সর্ববৃহৎ গণতান্ত্রিক দেশ ছেড়ে পাকিস্তানে পালিয়ে যেতে চাস কেন? রুগ্ণ, অভুক্ত ভারতীয় সারমেয় বাবু বলল, দেখছিস না, আমার কেমন অবস্থা? খেতে পাই না, ডাস্টবিনেও হাড়-হাড্ডি নেই। শুনেছি তোদের দেশে অনেক খাবার, অর্থনীতির অবস্থা ভালো, তাই এসেছি সীমান্ত পাড়ি দিতে। কিন্তু তুই তো বেশ মোটাতাজা, ভালোই খাবার-টাবার পাচ্ছিস মনে হচ্ছে, তা কোন দুঃখে ভারতে পালাতে চাচ্ছিস? পাকিস্তানি কুকুরটি কেউ শুনছে কি না তা পরখ করতে আশপাশ দেখে নিয়ে গলার স্বর নিচু করে বলল, তা তুই ঠিকই বলেছিস, আমাদের দেশে খাবারের অভাব নেই, ফিল্ড মার্শাল সাহেব অর্থনীতির ভালোই উন্নতি করেছেন; কিন্তু তিনি যে আমাদের ঘেউ ঘেউ করতে দেন না! টুঁশব্দটি করলেই সোজা চৌদ্দ শিকের ভেতর চালান করে দেন। কোনো কথা বলার উপায় নেই, সমালোচনা তো দূরের কথা। তাই তোদের ভারতে পালিয়ে গিয়ে ইচ্ছামতো একটু ঘেউ ঘেউ করব ভাবছি। মনে অনেক কথা জমে আছে যে! এরপর পাকিস্তানি কুকুরটি ভারতে চলে গিয়েছিল ঠিকই, তবে তার ভারতীয় জাতভাই পাকিস্তানে ঢুকেছিল কি না জানা যায়নি।
কৌতুকটি দুই কুকুরকে নিয়ে হলেও ফিল্ড মার্শাল আইয়ুব খানের সময় কিন্তু সংযুক্ত পাকিস্তান প্রকৃতই অর্থনৈতিক ও কারিগরি দিকে ঈর্ষণীয় উন্নতি করেছিল। নিবন্ধটিতে সামনে এগোনোর আগে বিনয়ের সাথে বলে নিই যে, এখানে আইয়ুব শাহীর গুণগান করা বা সে সময়কার পাকিস্তান ‘স্বর্গ’ ছিল এমন কোনো ধারণা দেয়ার জন্য এই লেখা নয়। বরং একটি জটিল আর্থসামাজিক সমীকরণ সহজভাবে বোঝানোর জন্যই এই ক্ষুদ্র প্রয়াস, যার ইঙ্গিত ওই কৌতুকেই দিয়েছি। কোনো একটি দেশে শুধু অর্থনৈতিক উন্নয়নই সব? নাকি সামগ্রিকভাবে গণতন্ত্রের উন্নয়ন প্রয়োজন সেটি আজ গভীরভাবে ভেবে দেখার সময় এসেছে।
যা হোক, সেসময় সমগ্র এশিয়ায় পাকিস্তানকে ধরা হতো শিল্পায়ন ও অর্থনৈতিক অগ্রগতির রোল মডেল হিসেবে। পৃথিবীর নামকরা সব বহুজাতিক কোম্পানি পাকিস্তানে বিনিয়োগ ও কারখানা স্থাপন করে। ইউনিলিভার, কোকাকোলা, ফাইজার, গ্ল্যাক্সো, ব্রিটিশ আমেরিকান টোব্যাকোসহ প্রভৃতি কোম্পানির নাম উল্লেখযোগ্য। ইউরোপ, আমেরিকার বিখ্যাত সব বিলাস সামগ্রী ও ইলেকট্রনিক্স তখন পাকিস্তানে সহজলভ্য। পক্ষান্তরে, ভারতে জওয়াহেরলাল নেহরু মুক্তবাজার অর্থনীতি অনুসরণ করতে অস্বীকৃতি জানান ও অনেকটা সমাজতান্ত্রিক ধাঁচে অর্থনীতি গড়ে তোলেন। সেখানে বলতে গেলে কোনো বিদেশী কসমেটিকস, গাড়ি, বিলাস দ্রব্য পাওয়া যেত না। পাকিস্তানের মানুষ যখন ৫৫৫ বা বেনসন অ্যান্ড হেজেস সিগারেট পান করত তখন ভারতের সবচেয়ে ভালো সিগারেট ছিল স্থানীয়ভাবে তৈরি চারমিনার। বেশির ভাগ ভারতীয় ধূমপান করত টেন্ডু পাতার বিড়ি দিয়ে। করাচি, লাহোর, ঢাকায় যখন জার্মানির গ্রুনডিগের মতো বিশ^খ্যাত কোম্পানির রেডিওগ্রাম, টেপরেকর্ডার পাওয়া যেত তখন ভারতীয়দের কাছে এসব ছিল স্বপ্নের মতো। এমনকি তখন দক্ষিণ কোরিয়া, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া, সিঙ্গাপুরের মতো দেশগুলো অতটা উন্নতি লাভ করেনি। ওই সব দেশ থেকে সরকারি বিশেষজ্ঞরা পাকিস্তানে আসতেন উন্নয়নের গূঢ় রহস্য জানার জন্য। পাকিস্তান কিভাবে অত দ্রুত ব্যাপক শিল্পায়ন ও জিডিপি বৃদ্ধি করতে সক্ষম হলো তা নিয়ে এসব দেশের ছিল বিস্ময়। দক্ষিণ কোরিয়া, সিঙ্গাপুর আইয়ুব খানের অর্থনৈতিক পলিসি প্রায় হুবহু অনুসরণ করে বলে জানা যায়। আর মালয়েশিয়া পুত্রজায়ায় যে প্রশাসনিক শহর তৈরি করেছে তা ছিল ইসলামাবাদের মডেল। যে কেউ সেই সময়ে এসব দেশের অর্থনৈতিক অবস্থার বিপরীতে সাম্প্রতিককালে তাদের অবস্থা বিশ্লেষণ করলে অবাক হবেন।
১৯৪৭ সালে যখন ভারত ও পাকিস্তান দু’টি স্বাধীন দেশ হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভ করে তখন পূর্ব বাংলা ছিল সবচেয়ে অনগ্রসর এলাকা। এর রাজধানী ঢাকায় শুধু একটি আধা পাকা ইট বিছানো (হেরিংবোন) সড়ক ছিল পুরনো বিমানবন্দর থেকে শাহবাগ পর্যন্ত। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় মার্কিন সেনা প্রকৌশলীরা ওই সড়কটি ও বিমানবন্দর অবকাঠামো তৈরি করে। সেসময় ঢাকায় কোনো পেট্রল পাম্পও ছিল না। ১৯৪৭-এর পর তড়িঘড়ি করে রমনা পেট্রল পাম্পটি স্থাপন করা হয়, যা এখনো আছে। পুরো পূর্ব বাংলায় শিল্প কারখানা বলতে ছিল মাত্র তিন কী চারটি অবকাঠামো। সেগুলোর মালিকও ছিল হিন্দু সম্প্রদায়ের যারা দেশভাগের পর ভারতে চলে গিয়েছিলেন। এখানে ছিল না কোনো সামরিক শিক্ষা স্কুল বা ক্যাডেট কলেজ। পাটের কারখানাগুলো ছিল সব পশ্চিম বাংলায়। পাকিস্তান হওয়ার পরও তদানীন্তন শাসকরা পূর্ব বাংলার উন্নয়নে খুব একটা গা করেননি। যে পরিমাণ বিনিয়োগ ও প্রকল্প গ্রহণ করলে অর্থনীতির চাকা দ্রুততর করা যেত, তা উপেক্ষিত থেকে যায়। পাকিস্তানি রাজনীতিবিদরা একটি শক্তিশালী গণতান্ত্রিক কাঠামো তৈরি তো দূরের কথা, এমনকি সংবিধান প্রণয়নেও ব্যর্থ হন। এ অবস্থায় ১৯৫৮ সালে সামগ্রিক একটি হতাশাজনক পরিস্থিতিতে সামরিক শাসন জারি করা হয়। একপর্যায়ে পাক সেনাবাহিনীর তদানীন্তন কমান্ডার ইন চিফ জেনারেল আইয়ুব খান ক্ষমতার মসনদ কুক্ষিগত করতে সক্ষম হন। পৃথিবীর প্রায় সব একনায়ক যা করেন তিনিও তাই করেছিলেন। তার মাথায় চেপে বসে সব ছেড়ে ছুড়ে কেবলমাত্র দ্রুত অর্থনৈতিক অগ্রগতির চিন্তা। তিনি অন্য সব টাইরান্টের মতো অবসেশনে ভুগতে শুরু করেন। ইগো চেপে বসে অস্থি মজ্জায়। সারাক্ষণ এক কথা, অর্থনৈতিক উন্নয়ন। আর রাজনীতি, গণতন্ত্র, সমাজনীতি, সংস্কৃতির অবাধ বিকাশ, মতপ্রকাশের স্বাধীনতাকে গণ্য করা হয় অর্থনৈতিক অগ্রগতির অন্তরায় হিসেবে। তার কথিত থিওরি ছিল দ্রুত অর্থনৈতিক অগ্রগতি করতে পারলে মানুষ এমনিতেই রাজনীতির কথা ভুলে যাবে, দেশ শক্তিশালী হবে। গণতন্ত্র তার কাছে ছিল অস্থিতিশীলতা সৃষ্টির উপকরণমাত্র। তাই খেয়ে না খেয়ে তিনি পুরো প্রশাসনকে নিয়োগ করেন অর্থনৈতিক উন্নয়ন নিশ্চিত করার কাজে। এখানে আইয়ুব আমলে পাকিস্তান ও ভারতের মধ্যে কয়েকটি তুলনামূলক তথ্য উপাত্ত তুলে ধরা হলো :
১. আইয়ুব খানের সময় কেবল পূর্ব-পাকিস্তানে ৭৭টি পাটকল প্রতিষ্ঠা করা হয় যার মধ্যে আদমজী জুট মিল ছিল পৃথিবীর সবচেয়ে বড় পাটকল। ১৯৪৭ সালে পূর্ব পাকিস্তানে কোন পাটকল ছিল না। এ ছাড়া ফিল্ড মার্শাল সাহেবের আমলে পাকিস্তানের জিডিপি প্রবৃদ্ধি ১০-এর ঘরও ছাড়িয়ে গিয়েছিল। অন্য দিকে সেসময় ভারতের ডিডিপি প্রবৃদ্ধি ছিল ৩-এর মতো।
২. আজকের প্রজন্মের অনেকেই হয়তো অবাক হবেন জেনে যে, আইয়ুব খানের আমলেই মার্কিন সহায়তায় পূর্ব-পাকিস্তানের ঢাকায় টেলিভিশন স্টেশন বসানো হয় ১৯৬৪ সালে। এশিয়ায় জাপানের পর এখানে টেলিভিশন দেখতে সক্ষম হয় পূর্ব-পাকিস্তানের নাগরিকরা। পরে পশ্চিম-পাকিস্তানে টেলিভিশন কেন্দ্র বসানো হয়। ভারতে টেলিভিশন আসে আরো অনেক পরে। সেসময় বায়তুল মোকাররম, স্টেডিয়াম মার্কেটের পাশাপাশি নিউ মার্কেট তৈরি হয়। এসব মার্কেটে বিদেশী সব পণ্য পাওয়া যেত যা ভারতে নব্বই দশক পর্যন্ত কল্পনাও করা যেত না।
৩. ১৯৬৪-৬৫ সালে জার্মানি ও ফ্রান্স থেকে এয়ারকন্ডিশন্ড বগি এনে পাকিস্তান রেলওয়েতে সংযুক্ত করা হয়। ঢাকা থেকে চট্টগ্রামগামী চিটাগাং মেইল ট্রেনে সেই বগিগুলো সম্ভবত প্রথম সংযুক্ত করা হয় পূর্ব-পাকিস্তানে। গ্রিন অ্যারো নামের একটি দ্রুতগামী ট্রেন যেটা ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম পথে চলাচল করত তাতেও সংযুক্ত হয় ওই সব বগি। সেই বগিগুলো অবাক ব্যাপার হলেও এখনো বাংলাদেশ ও পাকিস্তানে চলছে। ভারতে শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত রেল বগি আসে কয়েক বছর পর।
৪. আজ অবিশ্বাস্য মনে হলেও পাকিস্তান ইন্টারন্যাশনাল এয়ারলাইনস-পিআইএ আইয়ুব খানের সময় পৃথিবীখ্যাত বিমান সংস্থায় পরিণত হয়। এর কেবিন ক্রুদের পোশাক ফ্রান্সের বিখ্যাত ফ্যাশন ডিজাইনার সদ্য প্রয়াত পিয়েরে কার্ডিন স্বয়ং ডিজাইন করেছিলেন। পিআইএ পৃথিবীতে প্রথম ইন ফ্লাইট মুভি দেখানোর পদ্ধতির প্রচলন করে যা পরে পিআইএ’র সম্মতিক্রমে আমেরিকান বিমান সংস্থা প্যান এ্যাম তাদের বিমানে যুক্ত করে। করাচি থেকে লন্ডন রুটে বোয়িং ৭০৭ নিয়ে পিআইএ দ্রুতগতির ফ্লাইট পরিচালনার যে রেকর্ড বিগত শতকের ষাটের দশকে স্থাপন করে তা আজো কোনো এয়ারলাইনস ভাঙতে পারেনি। ভারতের কোনো বিমান সংস্থার এমন কোনো জৌলুশ ছিল না সেসময়।
৫. কমলাপুর রেলস্টেশন ও পৃথিবীর অন্যতম বিখ্যাত আর্কিটেক্ট লুই কানের ডিজাইনে করা সেকেন্ড ক্যাপিটাল (আজকের সংসদ ভবন ও পারিপার্শ্বিক এলাকা) সেসময় এশিয়ায় অন্যতম স্থাপত্য হিসেবে স্বীকৃত ছিল। ভারতে এমন কোনো আধুনিক স্থাপত্য সে সময় তৈরি হয়নি।
৬. ঢাকায় প্রথম শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত সিনেমা হল হলো গুলিস্তান। এরপর মধুমিতা, আনন্দ, বলাকা, অভিসারসহ অনেকগুলো শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত সিনেমা হল স্থাপন করা হয় আইয়ুব শাসনামলে। ভারতে ওই রকম আধুনিক শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত সিনেমা হল তখনো ছিল না।
৭. পাকিস্তানের বড় শহরগুলোয় আমেরিকা ও ইউরোপের সব বিখ্যাত ব্র্যান্ড যেমন গ্রুনডিগ, রোলেক্স, ফিলিপস, তোশিবার পণ্য পাওয়া যেত। সড়কে চলত ইতালির ফিয়াট, আমেরিকার শেভ্রলে, জার্মানির ফোক্স ওয়াগেন, জাপানের টয়োটা যা ভারতে সহজলভ্য ছিল না। সেখানে জাপানের পুরনো মডেলের লাইসেন্স নিয়ে তৈরি করা হতো অ্যাম্বাসাডর গাড়ি। বিদেশী কোনো বিলাসী ও চকচকে গাড়ি স্বপ্নেও কেউ ভাবতে পারত না।
৮. পাকিস্তানে তখন বিশ্বখ্যাত পানীয় কোকাকোলা, সেভেন আপের কারখানা ছিল। ইউনিলিভার এই উপমহাদেশে প্রথম কারখানা করে পাকিস্তানে। তখন ভারতে এসব ছিল না। তাদের সবচেয়ে ভালো পানীয় ছিল থামস আপ। নব্বই দশকে মুক্তবাজার অর্থনীতির প্রচলন হওয়ার পরই কেবল এসব প্রতিষ্ঠান ভারতে যাওয়ার সুযোগ পায়।
আরো কিছু উদাহরণ এখানে দেয়া যেত। তালিকা দীর্ঘ করে লাভ নেই। আর পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের অর্থনৈতিক বৈষম্য এখানে আলোচনার বিষয় নয়। লক্ষণীয়, বিশাল ভারত যার ব্রিটিশের রেখে যাওয়া শিল্প অবকাঠামো ছিল সেই ভারত কিন্তু চাকচিক্য, বিলাসিতা ও বিদেশী দ্রব্যের ওপর নির্ভর করেনি। পণ্ডিত জওয়াহেরলাল নেহরুর মতো ঝানু রাজনীতিবিদ ও জ্ঞানী মানুষ জানতেন ও বুঝতেন পাকিস্তান যা করছে তা একনায়কতন্ত্র আশ্রিত দেশ করেই থাকে গণতন্ত্রের অনুপস্থিতি চাপা দেয়ার জন্য। নেহরু জোর দিয়েছিলেন ধীরে হলেও গণতন্ত্রের ভিত্তি জোরদার করার কাজে। তিনি গুরুত্ব দিতেন সিভিলিয়ান কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার ওপর, পেশাদার সিভিল ও মিলিটারি আমলাতন্ত্র নিশ্চিত করার ওপর, মানুষের দেশীয় পণ্য ক্রয় এবং সাধারণ কিন্তু মর্যাদাসম্পন্ন জীবন ধারণের ওপর। তিনি সমগ্র সশস্ত্র বাহিনীকে এমনভাবে ঢেলে সাজিয়েছিলেন যে তা সে সময় পাকিস্তান মিলিটারির মতো জৌলুসপূর্ণ না হলেও দায়িত্বশীল হয়ে গড়ে উঠেছিল। কম খেয়ে, কম পরে, মানুষ কিভাবে সম্মানের সাথে বসবাস করতে পারে তা শিখিয়ে দিয়ে গিয়েছিলেন নেহরু। গণতন্ত্রের ভিত্তি জোরদার করে দিয়ে গিয়েছিলেন বলেই আজ পর্যন্ত সেখানে কখনো সেনা শাসন আসেনি, সশস্ত্র বাহিনী বিদ্রোহ করেনি, বেসামরিক প্রশাসন নিয়ে কটু কথা হয়নি, একজন সিভিল সার্ভিস অফিসারের যোগ্যতা, মান নিয়ে কেউ প্রশ্ন তুলতে পারেনি।
কিন্তু ফিল্ড মার্শাল আইয়ুব খানের সময় চোখধাঁধানো সব হাজারো ‘উন্নয়ন’ ও ‘অর্জনের’ পরও পাকিস্তান স্বাধীনতা লাভের পর মাত্র ২৪ বছরের মাথায় ভেঙে যায়। নেহরুর মেয়ে ইন্দিরা গান্ধী সাফল্যজনক নেতৃত্ব দিয়ে ১৯৭১ সালে পাকিস্তানকে পরাজিত করেন এবং ভারতের শ্রেষ্ঠত্ব কায়েম করেন দক্ষিণ এশিয়ায়। কম চাকচিক্যের অর্থনীতি নিয়ে ভারত টিকে যায়। এখনো কেউ ভারতকে ভাঙতে পারেনি। চীনের মতো মহাশক্তি বহু চেষ্টা করেছে ভারতের ক্ষতি করতে। করোনা মহামারীর সময় লাদাখে চীন যেভাবে আক্রমণ করেছিল, তাতে অনেকেই ভেবেছিলেন যে চীন হয়তো সিকিম পর্যন্ত দখল করে নেবে। ওই যুদ্ধে ভারত অসুবিধায় পড়েছে সত্য, কিন্তু কূটনীতি ও জাতীয়তাবোধ দিয়ে মহাচীনকে নিরস্ত করতে পেরেছে। আইয়ুব খানের আমলে পাকিস্তানিরা ভারতের দারিদ্র্য ও অতি সাধারণ মানের জীবনযাপন নিয়ে ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ করত। তাদের আমলাদের মধ্যে তো রীতিমতো একটা ভাব চলে এসেছিল যে, ভারতের দরিদ্র শ্রেণী অর্থনীতির বেহাল দশায় রুখে দাঁড়াবে। কিন্তু তা কখনোই হয়নি। ভারত ভাঙেনি, ভেঙেছে পাকিস্তান। এটিই বাস্তবতা। কেন? ভারতে গণতন্ত্র ছিল। ওয়াগাহ সীমান্তের ওই কুকুরটির মতো সেখানে সবাই মতপ্রকাশ করতে পারত, ‘ঘেউ ঘেউ’ করতে পারত। সংসদে সরকারের সব কাজের ইতিবাচক, নেতিবাচক দিকের সমালোচনা হতো। সংবাদমাধ্যম, বিচার বিভাগ ছিল স্বাধীন।
সুতরাং অবধারিতভাবেই গণতন্ত্র বিকশিত হয়েছে। ভারত এগিয়েছে ধীরে। কথিত অর্থনৈতিক উন্নয়নকেই কেবল প্রাধিকারভুক্ত বা একমাত্র লক্ষ্য নির্ধারণ করেনি। সামাজিক যুথবদ্ধতা, ন্যায়বিচার, জবাবদিহিতা এগুলোকে অগ্রাধিকার দিয়েছে। এরপর গত শতকের নব্বই দশকে মুক্তবাজার অর্থনীতি গ্রহণ করার পর ভারত আজ বিশ্বের অন্যতম দ্রুত বর্ধনশীল অর্থনীতি। এই উপমহাদেশে পাকিস্তান ও ভারতের এই পার্থক্য থেকে আমরা সহজেই যে উপসংহারে আসতে পারি তা হলো- আগে গণতন্ত্র, তার পর অর্থনীতি। অর্থনৈতিক উন্নয়ন প্রয়োজন। তবে আগে দরকার মানুষ ও সমাজের বিকাশ। চাই উন্নত গণতন্ত্র। চাই গণতন্ত্রের উন্নয়ন। অর্থনৈতিক উন্নয়ন এর একটি অংশমাত্র, পুরো সমাধান নয়। মনে রাখা দরকার, গণতন্ত্রই ভারতকে টিকিয়ে রেখেছে। পৃথিবীর কোনো দেশ সামাজিক যুথবদ্ধতা, সামাজিক ন্যায়বিচার, সুশাসন ও গণতন্ত্রের চিন্তা না করে শুধু অর্থনৈতিক উন্নয়ন দিয়ে টিকতে পারেনি, পারবেও না। নৈরাজ্য তাদের গ্রাস করবেই। ইরাক, লিবিয়া, সিরিয়া, ভেনিজুয়েলা তার জ্বলন্ত প্রমাণ। অনেকেই আফসোস করে বলেন, গাদ্দাফির সময় লিবিয়া কত উন্নত ছিল! সাদ্দামের সময় ইরাকে দুধের নহর বইত! সিরিয়ায় কত সুন্দর শহর ছিল! আজ সেসব কোথায়?
ভেনিজুয়েলা একসময় ছিল পৃথিবীর অন্যতম ধনী দেশ। তেল রফতানি করে অর্থের পাহাড় গড়েছিল। আজ সেই দেশ থেকে করোনা মহামারীর মধ্যেও মানুষকে পালিয়ে কলম্বিয়াতে আশ্রয় নিতে হয়। চল্লিশ লাখ ভেনিজুয়েলান এ যাবৎ দেশ থেকে পালিয়ে গেছে। সিরিয়া ধ্বংসস্তূপ। সে দেশ থেকেও পালিয়েছে প্রায় চল্লিশ লাখ সিরিয়ান। কেন মানুষ তার নিজ ঘরবাড়ি ছেড়ে ভিন দেশে বনে জঙ্গলে আশ্রয় নেয়? কোনো গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র থেকে মানুষ এভাবে পালিয়ে যায় না! গণতান্ত্রিক কোনো দেশে মানুষ কম খেয়ে, কম পরে থাকতে পারে। তার চাই শান্তি, স্থিতিশীলতা, রিজিকের নিশ্চয়তা, নিরাপত্তা, নিজ বিশ্বাসের মর্যাদা। এগুলো না থাকলে শুধু বাহ্যিক চাকচিক্য কোনো সমাধান দিতে পারে না।
মূল উপসম্পাদকিয়-টি দৈনিক নয়াদিগন্ত-এর ০৬ এপ্রিল ২০২১ প্রকাশ করা হয়েছিল।
মূল লিঙ্কঃ সীমান্তের দুই কুকুর ও গণতন্ত্রের উন্নয়ন
Abu Rushd, the President of the Institute of Strategy and Tactics Research (ISTR), is a towering figure whose unparalleled experience spans military service, defense journalism, and global intelligence analysis. A former military officer turned investigative journalist, Abu Rushd brings over three decades of expertise in national security, international relations, and defense intelligence, making him an authoritative voice in shaping strategic discourse on global security challenges.
As a pioneer of defense journalism in Bangladesh, Abu Rushd has continuously pushed the boundaries of investigative reporting. He introduced defense and intelligence coverage into Bangladeshi media and established the Bangladesh Defence Journal, the country’s only publication dedicated to these critical issues. His in-depth understanding of intelligence agencies, military operations, and insurgency conflicts is reflected in his eight widely acclaimed books, with works cataloged in prestigious institutions like the University of Chicago, Yale University, and the University of Toronto.
Rushd's fearless journalism has taken him from the conflict zones of Sierra Leone to the reconstruction efforts in South Sudan. He has served as an official media partner at global defense expos, providing high-level analysis and insights into international security operations. His work on intelligence agencies, including his influential book on Indian espionage RAW in Bangladesh, stands as a testament to his commitment to uncovering hidden geopolitical forces.
As the President of ISTR, Lt. Abu Rushd's leadership reflects a rare combination of military precision, investigative rigor, and intellectual boldness. His visionary approach is essential for advancing strategic research that influences policy and shapes the future of global security.