Homeবাংলা শাখাবাংলাদেশ দখলের হুমকি দিয়ে লাভ কার

বাংলাদেশ দখলের হুমকি দিয়ে লাভ কার

‘একটি ক্ষুদ্র দেশের জন্য সর্বাপেক্ষা ভালো প্রতিবেশী হচ্ছে একটি ধনী দেশ, যার রয়েছে ক্ষুদ্র একটি সেনাবাহিনী। কিন্তু সবচেয়ে ভয়াবহ শত্রু হচ্ছে বৃহৎ সেনাবাহিনীর অধিকারী দরিদ্র একটি দেশ।’ -নেপালের অধ্যাপক জি বি খানাল, ১৯৮৯ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর সংখ্যা নিউজউইকে উদ্ধৃত।

খুবই খারাপ লাগে এটি ভেবে যে, আমাদের প্রতিবেশী একটি বৃহৎ দেশের প্রায় ৫০ শতাংশ নাগরিকের টয়লেট নেই, গ্লোবাল হাঙ্গার ইনডেক্সে অবস্থান ১০১তম যেখানে বাংলাদেশের অবস্থান ৭৬। মাথাপিছু আয় আমাদের চেয়ে কম। করোনা মহামারীতে মৃতদের একটি বড় অংশকে গঙ্গা নদীতে ভাসিয়ে দিতে হয়েছে সৎকার করার সামর্থ্য নেই বলে। তবে প্রফেসর খানাল যা বলেছিলেন ঠিক সেভাবেই তাদের রয়েছে বিশাল সশস্ত্রবাহিনী। পৃথিবীতে অস্ত্র আমদানিতে তাদের অবস্থান দ্বিতীয়। পারমাণবিক শক্তিচালিত সাবমেরিন, বিমানবাহী রণতরী সজ্জা দেখলে মনে হবে তারা বিশাল কোনো সামরিক শক্তি বনে গেছে। অবশ্য পশ্চিম সীমান্তের একটি দেশের সাথে আকাশে লড়তে গিয়ে তাদের পাইলট সাহেব চা খেয়ে ফেরত এসেছেন। আর হলুদ একটি জাতির সাথে সীমান্তে প্রায়ই ঝামাপিটার সম্মুখীন হয় বলে চার দিকে হইচই শোনা যায়। কথাগুলো কঠিন হয়ে গেল? হবেই তো। কেউ আমার মাতৃভূমিকে আগ্রাসন চালিয়ে দখল করে নিতে চাইলে কি কলম দিয়ে মৃদু শব্দ বেরোবে?

সেই বৃহৎ হাতিসম প্রতিবেশী দেশটির শাসক দলের উপদেষ্টাদের অন্যতম সুব্রামনিয়াম স্বামী। তিনি ‘বিশিষ্ট চিন্তক, কৌশলগত বিষয়ে এক্সপার্ট’! এমন একটি দানবাকৃতির দেশের এক্সপার্টের অবধারিতভাবে বিশালাকৃতির মগজ থাকা উচিত। ১২০ কোটি মানুষ থেকে বেছে তো অন্তত এমনই পাওয়ার কথা। এই স্বামীজি প্রায়ই বাংলাদেশ নিয়ে ফতোয়া জারি করেন, সেই সত্তর দশক থেকেই করে আসছেন। গত ১৮ অক্টোবর তার টুইটার অ্যাকাউন্টে ভারতীয় সময় সকাল ৫টা ১৮ মিনিটে তিনি অমনি এক ফতোয়া জারি করেছেন। হুঙ্কার দিয়ে বলেছেন, ‘ভারতের উচিত বাংলাদেশে আগ্রাসন চালানো…’। তিনি হরহামেশাই এমন হুমকির সুরে কথা বলেন। মনে হয় এটিই যেন ভারতের পলিসি হতে চলেছে! কোন যদু মধু হলে তার কথাকে পাগলের প্রলাপ বলে এড়িয়ে যাওয়া যায়। কিন্তু স্বামী মশাই যে একেবারে সরকারি দলের উপদেষ্টা। আজ যদি বাংলাদেশের সরকারি দলের কোনো জাহাবাজ নেতা বা প্রতিরক্ষা উপদেষ্টা কোনো দেশ দখল করার জন্য প্রকাশ্যে তার টুইটার অ্যাকাউন্টে নসিহত করেন, তা হলে তাকে অবশ্যই সিরিয়াসলি নিতে হবে। বৃহৎ হস্তির ততোধিক বৃহৎ মগজধারী উপদেষ্টা সুব্রামনিয়ামের কথাও এ কারণে গণনায় নিতে হয়। তিনি ও তার সতীর্থরা প্রায়ই এমন চিৎকার দিয়ে ওঠেন। এটি বাস্তবতাবাদী ও সুস্থ মস্তিষ্কের কোনো মানুষের কাছে ‘শিৎকার’ বলে মনে হতে পারে।

বলি মশাই পেয়েছেনটা কী? কথায় কথায় ১৬ কোটি মানুষের একটি দেশ আক্রমণের হুমকি দেবেন। এ দেশ তো আপনাদের ঋণ কম শোধ করেনি। এখনো করে চলেছে। জানি দুশমন পাকিস্তানের বিরুদ্ধে আপনাদের রণকৌশল বাস্তবায়নে সহায়তা করেছে, করে আসছে; ১৯৭১ এ একই ধর্মের হয়েও জয় বাংলা বলে দেশটাকে ভেঙে দিয়েছে, ৩০ লাখ জীবন দিয়েছে। এসব তো আপনাদের চিরজীবনের শখ ও সাধ পূরণ করেছে। আপনারাই শুধু আমাদের সহায়তা করে দেশ বানিয়ে দিয়েছেন? আমরা কি জীবন দিয়ে আপনাদের ভূরাজনৈতিক কামনা-বাসনাকে তৃপ্ত করিনি? আমরা বাঙালিরা সাথে না থাকলে পাকিদের এত সহজে হারাতে পারতেন? ১৯৬৫ সালে তো বিষয়টি এতটা সহজ ছিল না। ঋণটা তো আপনাদেরও? আপনারা এ জন্য আমাদের কাছে ঋণী। সেই ঋণ শোধ করুন দেখি। তার পর কথা। এত হুঙ্কার দিয়ে কিসের বন্ধুত্ব প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন দেখেন? পৃথিবীর সর্ববৃহৎ গণতান্ত্রিক দেশটাকে আজ কি অবস্থায় নিয়ে গেছেন, সেই হুঁশ আছে?

বাংলাদেশ তৈরি হওয়ায় আপনারা যে কতটা বেঁচে গেছেন, তা তো বাংলদেশে দায়িত্ব পালনকারী আপনাদেরই হাইকমিশনার জে এন দীক্ষিত ১৯৯৬ সালের ২ এপ্রিল দৈনিক জনকণ্ঠের সাথে এক সাক্ষাৎকারে স্পষ্ট করে বলে গেছেন। বাংলাদেশ সৃষ্টির পেছনে ভারতের উদ্দেশ্য ব্যাখ্যা করতে গিয়ে তিনি বলেছিলেন, ‘আমাদের খুব গুরুত্বপূর্ণ প্রদেশ পশ্চিমবঙ্গের মানুষের আবেগ জড়িয়ে ছিল এই যুদ্ধের সাথে। আমরা যদি আপনাদের সাহায্য না করতাম, এই প্রদেশ হয়তো বাঙালি জাতীয়তাবাদের আবেগ নিয়ে সাহায্যে এগিয়ে যেত, বাঙালি আত্মপরিচয়ের আকাক্সক্ষা থেকে প্রদেশটি হতো, অবশেষে বিচ্ছিন্নতার দিকেও এগিয়ে যেত।… সে সময় পূর্ব পাকিস্তানকে ব্যবহার করে পূর্ব ভারতে পাকিস্তান যেসব তৎপরতা চালাচ্ছিল, তাতে আমরা অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছিলাম। আর এ ধরনের একটি ভাবনা আমাদের সব মহলেই গড়ে উঠেছিল যে, একটি স্বাধীন বাংলাদেশ হয়তো এসব সমস্যার সমাধান দেবে।’ জনাব সুব্রামনিয়াম, বাংলাদেশ কি এসব সমস্যার সমাধান দেয়নি? আমাদের সরকার কি ভারতের স্বার্থ ক্ষুণ্ণ হোক এমন সব তৎপরতার রাশ টেনে ধরেনি? আপনারা কি উত্তর-পূর্ব ভারত এখনো ভারতের মূল অংশের সাথে রাখতে পারেননি? পেরেছেন। এক পাকিস্তান থাকলে বহু আগেই তা আলাদা হয়ে যেত। শেরে বাংলার তত্ত্ব অনুযায়ী সেই দুই মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশের একটি হিসাবে দুই বাংলা, আসাম নিয়ে বৃহত্তর বাংলা হয়ে যেত। তাই নয় কি? আমরা তো তা ঠেকিয়ে দিয়েছি। দয়া করে এই ঋণটা ভুলবেন না।

যেই ভারতকে আমরা গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা ও বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চার অন্যতম তীর্থস্থান বলে হৃদয়ে আশ্রয় দিয়েছিলাম, সেই দেশটি আজ কোন পর্যায়ে পৌঁছেছে? আমাদের লজ্জা লাগে তা ভাবতে। মেধার এত অধঃপতন দেখে আশঙ্কিত হতে হয় হরহামেশাই। কঠিন করে বলছি, তাতে অনেকের গায়ে জ্বলবে। কিন্তু অপরূপ বৈচিত্র্যের মধ্যে যে দেশটিকে চিনে এসেছি, তাকে আজ নিচে নামতে দেখলে খারাপ লাগে। এটি এ কারণেই যে সেই দেশটির অধঃপতন আমাদেরও প্রভাবিত করে।

অবশ্য জনাব সুব্রামনিয়াম স্বামী ও কিছু রগচটা, উগ্রবাদী কথিত গবেষক বরাবরই বাংলাদেশ নিয়ে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করে এসেছেন। স্বামী মহোদয় বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার ঠিক পরপর সেই ১৯৭২ সালে ‘Bangladesh and India’s Securiy’ শিরোনামের এক নিবন্ধে বলেছিলেন, ‘It’s (Bangladesh) existence constitutes a weak point in Indian security in the strategic north east region. Should events in Assam and the other tribal states in that region, or in neighboring Burma, cause deterioration in India’s control of the area, Bangladesh proximity would be a critical factor’. [Compiled and published by Maj Gen D. K. Palit and Dutt Publishers]. অর্থাৎ বাংলাদেশ স্বাধীন হয়ে দু’দণ্ড দম নিতে পারেনি, স্বামী সাহেব ঠিকই বলে দিয়েছিলেন যে ভারতের কৌশলগত উত্তর-পূর্ব অঞ্চলের নিরাপত্তার জন্য বাংলাদেশ একটি দুর্বল অবস্থান তৈরি করেছে। যদি আসাম ও এর আশপাশের এলাকা ও বার্মায় পরিস্থিতি খারাপ হয়; তা হলে বাংলাদেশের অবস্থান হবে ভারতের নিরাপত্তার স্বার্থে এক অতি গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু। এখন তো তাই হচ্ছে। সুব্রামনিয়াম স্বামীরা বাংলাদেশের স্বাধীন অস্তিত্বকেই যেন ভারতের নিরাপত্তার জন্য হুমকি মনে করেন। কিন্তু এ কথা ভুলে যান যে স্থিতিশীল, গণতান্ত্রিক, উন্নত বাংলাদেশই পারে ভারতকে সেই নিরাপত্তা দুশ্চিন্তা থেকে দূরে রাখতে। বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতি, সংস্কৃতি, মিডিয়ায় হস্তক্ষেপ ও নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা কখনো সেই নিরাপত্তা দিতে পারে না, পারবেও না। কারণ নিরাপত্তাহীনতা থেকে বাংলাদেশ বরং আরো চীনের দিকে ঝুঁকবে এবং ঝুঁকছে। স্বামীজিদের হাই হ্যান্ডেডনেস অজান্তেই তাদের নিরাপত্তার সঙ্কটকে আরো ঘনীভূত করছে বাংলাদেশে চীনের অব্যাহত প্রভাব বৃদ্ধির মধ্য দিয়ে। এ জন্য বাংলাদেশ যত না দায়ী, উগ্র মস্তিষ্কের কিছু কথিত বিশ্লেষক ও অবনতমস্তক স্তাবকরা তার চেয়ে বেশি দায়ী। তারা যদি মনে করে বাংলাদেশের সংস্কৃতিকে ভারতের সংস্কৃতির সাথে লীন করে দিয়ে, কয়েকটি মিডিয়াকে কব্জা করে, গোয়েন্দা সংস্থা দিয়ে একপক্ষীয় কায়দায় ভারতের নিরাপত্তা জোরদার হবে; তা হলে তা হবে কচু গাছে ফাঁসি দেয়ার মতো হাস্যকর। ভারতের শক্তিশালী গোয়েন্দা সংস্থা অনেক ক্ষমতাধর। অনেক কিছুই করতে পারে। কিন্তু শেষ ফলটা কী দাঁড়াচ্ছে? কত দিন, কতজনকে ভারতবিরোধী বানাবেন একটু সমালোচনা করলেই? কত দিন এক দিকে হেলে বাংলাদেশবিষয়ক সিদ্ধান্ত নেবেন কোনো বাছবিচার না করেই? চীনকে তো আপনারাই ডেকে নিয়ে এসেছেন বাংলাদেশে! নিরাপত্তাহীনতা যদি তৈরি না করতেন, এ দেশের মানুষের মধ্যে তা হলে কি চীনা দৈত্য এভাবে জেকে বসত? আমরা তো দুটো খেয়ে পরে, ব্যবসা বাণিজ্য করে দিন পার করতাম, যদি না আমাদের আত্মমর্যাদায় আঘাত না করতেন।

এবার আরেকজন জাহাবাজ সমরবিশারদের প্রসঙ্গ টানছি। তার নাম রবি রিখি। আমাদের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে তার তুচ্ছ-তাচ্ছিল্যকর মন্তব্যযুক্ত একটি বই রয়েছে। তিনি ভারতে উগ্রবাদী একজন বিশ্লেষক হিসেবে পরিচিত। এমন মানুষ সব দেশেই কমবেশি আছে। কিন্তু আবারো বলি, উনাদের নিয়ে ভাবতাম না, যদি না তারা তাদের রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে নমস্য না হতেন। ১৯৮৮ সালের ১১ সেপ্টেম্বর সংখ্যা দৈনিক আনন্দবাজারে ‘যুদ্ধে কেন ভারত বারবার হেরেছে’ শিরোনামে এক কলামে মন্তব্য করেন, ‘শেখ মুজিবুর রহমান যখন নিহত হন, তখন ইন্দিরা গান্ধী প্রথমে ঠিক করেছিলেন তিনি হস্তক্ষেপ করবেন। সেনাবাহিনীর তিনটি ডিভিশনকে সতর্কও করে দেয়া হলো। কিন্তু শেষে সরকার গড়িমসি করলেন এবং সুযোগ পেরিয়ে গেল। ফলে হলো কী? না, বাংলাদেশকে আমাদের শিবিরে রাখার সুযোগ আমরা হাতছাড়া করলাম। সোভিয়েত ইউনিয়ন যে যুক্তিতে পোল্যান্ড, আফগানিস্তানে এবং আমেরিকা নিকারাগুয়া ও গ্রানাডায় সেনা নামিয়েছিল; সেই যুক্তিতে ভারতও তখন বাংলাদেশে হস্তক্ষেপ করলে তা অসঙ্গত হতো না।’ তা আগ্রাসনটা কেন করতে পারেনি ভারত? চীনা হুঁশিয়ারি, আমেরিকার রাশ টেনে ধরা; পর্দার আড়ালের ইতিহাস তো তাই বলে। বাংলাদেশ ইজ নট এ কান্ট্রি টু বি কাউড ডাউন। এ দেশের ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট পাকিস্তান ভেঙে দিয়েছে যারা তাদের তৈরি করেছিল। এখনো ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট আছে জনাব স্বামীজি। আবার আরেকটি বাংলাদেশ ইনফেন্ট্রি রেজিমেন্ট বেড়েছে। আগ্রাসন এত সোজা হলে চলে আসুন, চীনকে পরে সামলাতে পারবেন তো? অরুণাচল, সিকিম থাকবে?

জনাব স্বামী মহাশয়, আমার লেখাটি পড়ে আপনাদের কিছু উগ্র মস্তিষ্কের সমর্থককুল আমাকে পাকিস্তানপন্থী, ভারতবিরোধী, চাইকি সাম্প্রদায়িক জঙ্গিও বানিয়ে দিতে পারেন; যা তারা প্রায়ই করে থাকেন। এভাবে বাংলদেশের বৃহত্তর জনগোষ্ঠীকেই আপনি ও আপনার গুণমুগ্ধ হট হেডেড শ্রেণী অজান্তেই যুক্তিহীনভাবে ভারতবিরোধী করে তুলছেন। আপনাদের কথা মানলে এ দেশের কোনো স্বাতন্ত্র্য থাকা যাবে না, সেনাবাহিনী থাকা যাবে না, সবাইকে জি হুজুর করতে হবে, সরকারকে চলতে হবে আপনাদের কথায়।

আপনাদের গোয়েন্দা সংস্থা শুধু যে এক বিশেষ শ্রেণীকে লাই দিয়ে মাথায় তুলছে, সেই খেয়াল হয়তো আপনার নেই। আমরা অবাক বিস্ময়ে লক্ষ করি, ভারতের কর্মকর্তারা শুধু একটি বিশেষ গণ্ডির মানুষজনের সাথেই মেশেন, তাদেরকেই বাংলাদেশ বলে মনে করেন, তাদের কর্মকাণ্ডকেই বাংলাদেশ বলে ভারতের জনগণের কাছে চিত্রিত করেন। সংখ্যাগরিষ্ঠ বাংলাদেশী সেখানে অনুপস্থিত। ভারতের মানুষ জানেও না, সেই সংখ্যাগরিষ্ঠের আকুলতা, ক্ষোভের কথা। এটি ভারতের জনগণের সাথে বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের যোজন যোজন ফারাক তৈরি করছে, তাও হয়তো আপনারা হিসাবে নিচ্ছেন না। আপনার মতো বিশেষজ্ঞের কথা পড়ে মানুষের ধারণা জন্মাচ্ছে যে, ভারতে এখন শুধু আগ্রাসী মনের মানুষই তৈরি হচ্ছে। কিন্তু আমার সম্পাদিত জার্নালে তো বিখ্যাত সমরবিদ জেনারেল জি ডি বাখশি কলাম লিখেন। তাকে টেলিভিশনে দেখা যায় প্রায়ই। কই তাকে তো মাথামোটা অকালকুষ্মাণ্ড বলে মনে হয় না। যেসব ভারতীয় সেনা অফিসারকে এ পর্যন্ত ব্যক্তিগতভাবে দেখেছি ও জেনেছি, তাদের প্রত্যেককেই আমার কাছে মনে হয়েছে বিশ্বসেরা, এ অঞ্চলের অন্য যেকোনো দেশের অফিসারদের চেয়ে প্রাজ্ঞ, টোটাল জেন্টলম্যান অ্যান্ড অফিসার। আমার জার্নালে ভারতীয় নৌবাহিনী প্রধানের একটি লেখা ছাপা হওয়ার পর স্থানীয় প্রতিরক্ষা উপদেষ্টা যেভাবে ও যে ভাষায় ধন্যবাদ দিয়েছিলেন, তা খুব কম জনের কাছ থেকেই পেয়েছি। সোলজার ইজ সোলজার- এটি তাদের দেখে বুঝতে কষ্ট হয় না। প্রশ্ন : সুব্রামনিয়াম, রবি রিখির মতো কয়েকজন এক বালতি দুধের মধ্যে এক বিন্দু গোচনা ঢালছেন কেন?

ভারতের একজন বিখ্যাত প্রবীণ সাংবাদিক শ্রী বেদ প্রকাশ বৈদিক। উনি বাংলাদেশে কয়েকবার এসেছিলেন। আমার সৌভাগ্য হয়েছিল তার একটি অনুষ্ঠান সাংবাদিক হিসেবে কভার করার। তিনি বলেছিলেন, ‘বাংলাদেশের মানুষের সাথে কথা বলে, মিশে আমি যা বুঝেছি তা হলো তোমরা চাও একজন স্নেহশীল বড় ভাই, মাতব্বরি ফলানো বিগ ব্রাদার নয়’। পরদিন আমার লেখা রিপোর্ট দৈনিকে শীর্ষ প্রতিবেদন হিসেবে ছাপা হয়েছিল। আমরা বড় ভাই চাই, হম্বিতম্বিওয়ালা কোনো বড় দাদা আমাদের দরকার নেই।

একজন মহান সৈনিক ফিল্ড মার্শাল মানেকশ’র কথা দিয়ে লেখাটা শেষ করছি। ১৯৭১ সালে ভারতীয় সেনাবাহিনীর প্রধান হিসেবে তার অবদান অবিস্মরণীয়। তার মতো জেনারেল পাওয়াও কোনো দেশের জন্য ভাগ্যের ব্যাপার। তার আত্মজীবনী আমার কয়েকবার পড়া হয়েছে। তিনি ঢাকা সফর করে ফিরে গিয়ে ভারতীয় সাংবাদিকদের বলেছিলেন, ‘বাংলাদেশে যদি ইসলামী প্রজাতন্ত্র ঘোষণা করা হয়, তা হলে ভারতের অবাক হওয়ার কিছু নেই। আমাদের সৈনিকরা যে দিন বাংলাদেশ মুক্ত করে সে দিনই আমি এই সত্য উপলব্ধি করি। বাংলাদেশের কখনোই ভারতের প্রতি তেমন ভালোবাসা ছিল না। জানতাম ভারতের প্রতি তাদের ভালোবাসা ক্ষণস্থায়ী। অনুপ্রেরণার জন্য তারা ভারতের দিকে না তাকিয়ে বরং মক্কা ও পাকিস্তানের দিকেই তাকাবেন। আমাদের সত্যাশ্রয়ী হওয়া উচিত’। (দৈনিক স্টেটসম্যান, কলকাতা, ২৯ এপ্রিল ১৯৮৮)। বাংলাদেশ কখনোই ইসলামী প্রজাতন্ত্র হয়নি, হবেও না। আমরা চাই না ভারতের প্রতি আমাদের ভালোবাসা ক্ষণস্থায়ী হোক। আমাদের আশা ভালোবাসাটা স্থায়ী হোক। এই উপমহাদেশের নিরাপত্তার জন্য তা জরুরি। মানেকশ’ হয়তো ভারতীয় রাজনীতিবিদদের আগ্রাসী মনোভাব লক্ষ করেই এমন হতাশাজনক মন্তব্য করেছিলেন। আমরা চাই না ভালোবাসাটা হারিয়ে যাক, একপেশে হোক। কিন্তু হম্বিতম্বি করে কি ভালোবাসা পাওয়া যায়? গোয়েন্দা সংস্থা লেলিয়ে দিয়ে বাংলাদেশের স্বাধীনচেতা মানুষগুলোকে কথায় কথায় পাকিস্তানপন্থী বানিয়ে প্রচারণা চালিয়ে কি ভালোবাসার দিকে এগোনো যায়? যায় না। এক হাতে তালিও বাজে না।

আমার এ লেখাটি নিয়েও যে পয়েন্ট অর্জনের বাসনায় গাঁজাখুরি রিপোর্ট করা হতে পারে, বা হুলো বেড়ালদের দিয়ে হুলোমি করা হতে পারে; সেটি মাথায় রেখেই বলছি, সমালোচনা সহ্য করতে হবে যদি গণতন্ত্র বলে দাবি করেন ভারতকে। আমাদের ডিগনিটি, অনার ক্ষুণ্ণ করে সম্মান বা শ্রদ্ধা কোনোটাই পাবেন না। ছোট হলেও আমরা প্রতিবেশী। সমস্যা থাকবেই। সমস্যা ছাড়া প্রতিবেশী নেই। স্তাবক শ্রেণীর কাছ থেকে তালিকা নিয়ে এ দেশের মানুষকে অযথাই শত্রুতার দিকে ঠেলে দেবেন না। এতে কারো লাভ নেই। সবার সাথে মিশুন। অন্তরটা প্রসারিত করুন। ছোট গণ্ডির মধ্যে ঘুরপাক খাওয়া হাতির সাজে না। ওতে হাতিই চাপা পড়ে যায়।

মূল উপসম্পাদকিয়-টি দৈনিক নয়াদিগন্ত-এর ২২ অক্টোবর ২০২১ প্রকাশ করা হয়েছিল।

মূল লিঙ্কঃ বাংলাদেশ দখলের হুমকি দিয়ে লাভ কার

Abu Rushd, Editor in Chief, Bangladesh Defence Journal
Editor in Chief at Bangladesh Defence Journal | Website |  + posts

Abu Rushd, the President of the Institute of Strategy and Tactics Research (ISTR), is a towering figure whose unparalleled experience spans military service, defense journalism, and global intelligence analysis. A former military officer turned investigative journalist, Abu Rushd brings over three decades of expertise in national security, international relations, and defense intelligence, making him an authoritative voice in shaping strategic discourse on global security challenges.

As a pioneer of defense journalism in Bangladesh, Abu Rushd has continuously pushed the boundaries of investigative reporting. He introduced defense and intelligence coverage into Bangladeshi media and established the Bangladesh Defence Journal, the country’s only publication dedicated to these critical issues. His in-depth understanding of intelligence agencies, military operations, and insurgency conflicts is reflected in his eight widely acclaimed books, with works cataloged in prestigious institutions like the University of Chicago, Yale University, and the University of Toronto.

Rushd's fearless journalism has taken him from the conflict zones of Sierra Leone to the reconstruction efforts in South Sudan. He has served as an official media partner at global defense expos, providing high-level analysis and insights into international security operations. His work on intelligence agencies, including his influential book on Indian espionage RAW in Bangladesh, stands as a testament to his commitment to uncovering hidden geopolitical forces.

As the President of ISTR, Lt. Abu Rushd's leadership reflects a rare combination of military precision, investigative rigor, and intellectual boldness. His visionary approach is essential for advancing strategic research that influences policy and shapes the future of global security.

Popular

Latest