Homeবাংলা শাখাক্ষমতার অলিগলিতে : কিছু আড়ালের কথা

ক্ষমতার অলিগলিতে : কিছু আড়ালের কথা

২০০৬ সালের নভেম্বর মাসে ইসলামাবাদে ম্যারিয়ট হোটেলে বাংলাদেশ সশস্ত্রবাহিনী দিবসের রিসিপশনে দেখা হলো ফিল্ড মার্শাল আইয়ুব খানের ছেলে গওহর আইয়ুব খানের সাথে। তিনি পাকিস্তানি সেনাবাহিনীতে ক্যাপ্টেন থাকাকালে চাকরি ছেড়ে দিয়ে সংসদীয় নির্বাচনে জয়ী হয়েছিলেন। সৈনিক পরিবারের ঐতিহ্য ধরে রাখার লক্ষ্যে তিনি ও তার বড়ভাই আখতার আইয়ুব যোগ দিয়েছিলেন সেনাবাহিনীতে। গওহর ছিলেন তার কোর্সের প্রথম; সে জন্য তাকে বিশ্বখ্যাত ব্রিটিশ রয়াল স্যান্ডহার্স্ট মিলিটারি একাডেমিতে পাঠানো হয়।

সেখানে একজন বিদেশী হয়েও তিনি ক্যাডেট সার্জেন্ট হিসেবে নিয়োগ পেয়েছিলেন যোগ্যতাবলে। অবশ্য তার পিতাও ছিলেন স্যান্ডহার্স্টে ব্রিটিশদের বাইরে প্রথম করপোরাল। কমিশন পাওয়ার পর গওহর সেনাবাহিনীতে যে ক’টি কোর্স করেছিলেন, তার সব ক’টিতে প্রথম স্থান অধিকার করেন। যদি সেনাবাহিনীতে থেকে যেতেন, স্বাভাবিকভাবেই তিনি সেনাপ্রধান হওয়ার মতো অফিসার ছিলেন। কিন্তু বাবার পরিচয়ের কারণে পরে ভিন্ন সরকারের সময় হয়তো হেনস্তার শিকার হতে হবে, এ কথা চিন্তা করে গওহর আইয়ুব সেনাবাহিনী থেকে পদত্যাগ করেন। আইয়ুব খান বারবার নিষেধ করার পরও তিনি তার সিদ্ধান্তে ছিলেন অটল। অবশ্য রাজনৈতিক অঙ্গনে ভিন্নকথাও শোনা যেত। যা হোক, বেসামরিক জীবনে গওহর যথেষ্ট ভালো করেছিলেন। নওয়াজ শরিফ মন্ত্রিসভায় ছিলেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও সংসদে নির্বাচিত হয়েছিলেন স্পিকার হিসেবে।

১৯৭১ সালে যুদ্ধে পরাজয়ের পর জুলফিকার আলী ভুট্টো পাকিস্তানের প্রথম বেসামরিক চিফ মার্শাল ল অ্যাডমিনিস্ট্রেটর ও প্রেসিডেন্ট নিযুক্ত হন। তখন গওহর আইয়ুব মুসলিম লীগের হয়ে ভুট্টোর শাসনের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ান। যা হোক, তার সাথে দেখা হওয়ার পর তিনি জানতে চাইলেন বাংলাদেশের তখনকার রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে। স্যান্ডহার্স্ট থেকে কমিশন পাওয়ার পর ১৯৫৬ সালে তার প্রথম পোস্টিং হয় ঢাকায় ১/১৪ পাঞ্জাব রেজিমেন্টে। তার বাবাও ওই রেজিমেন্টে কমান্ডিং অফিসার ছিলেন ব্রিটিশ আমলে। স্মৃতি-তাড়িত হয়ে তাই তিনি ঢাকার উন্নয়ন নিয়ে অনেক কিছু জানতে চাইলেন। বললেন ঢাকা ক্লাবে তাদের অবসর সময় কাটানোর কথা। সপ্তাহে দু’দিন যেতেন ওখানে। বিনোদন বলতে ছিল সিনেমা হলে রোববার সকালে মর্নিংশো এবং তেজগাঁও বিমানবন্দরে পিআইএ’র বিমানের ওঠানামা দেখা।

তিনি কুর্মিটোলা আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর প্রসঙ্গেও অনেক কথা বললেন। জানালেন, যুক্তরাষ্ট্র ওই বিমানবন্দর নির্মাণের জন্য ৪ দশমিক ৫ মিলিয়ন ডলার অনুদান দেয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল তৎকালীন প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খানকে। কিন্তু চীনের সাথে পাকিস্তানের বাণিজ্য চুক্তি হওয়ায় এবং পিআইএ’র বিমান পিকিংয়ে ফ্লাইট চালু করায় যুক্তরাষ্ট্র ভীষণ ক্ষুব্ধ হয়ে পড়ে। তারা আইয়ুব খানকে চীনের সাথে সহযোগিতা থেকে বের হয়ে আসার জন্য হুমকি দেন। পাক সরকার তাতে রাজি না হওয়ায় ১৯৬৪ সালে ঢাকা বিমানবন্দর নির্মাণের জন্য প্রতিশ্রুত পুরো ফান্ড বাতিল করে দেয় মার্কিন সরকার। ফলে কিছু কাজ হওয়ার পর বিমানবন্দর নির্মাণের কাজ আর এগোয়নি। আমি তাকে এই বিমানবন্দর সম্পর্কে যতটুকু জানি, বললাম। রাজনীতির প্রসঙ্গে ফিরে এসে একপর্যায়ে তিনি বেশ আস্থার সাথেই বললেন, ‘তোমাদের ওখানে সেনা হস্তক্ষেপ অত্যাসন্ন!’ বিএনপি যে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ও নির্বাচন কমিশন রেখে গিয়েছিল, তা নিয়ে আওয়ামী লীগ ও অন্যান্য বিরোধী পক্ষ মোটেই সন্তুষ্ট ছিল না এবং ব্যাপক আন্দোলন ছড়িয়ে পড়েছিল দেশব্যাপী।

তার পরও আমরা ধারণা করেছিলাম হয়তো প্রেসিডেন্ট ইয়াজউদ্দিন আহম্মেদ ‘ম্যানেজ’ করতে পারবেন সব পক্ষকে। গওহর আইয়ুবের কাছে তাই আশ্চর্য হয়ে জানতে চেয়েছিলাম, তিনি কিভাবে ওরকম ধারণা করছেন? তিনি তার অভিজ্ঞতার কথা উল্লেখ করে বলেছিলেন, রাজনীতিকে রাজনীতির মতো চলতে না দিলে ওরকম তো হতেই পারে। আরো বলেছিলেন, তার স্মৃতিচারণমূলক একটি বই বের হতে যাচ্ছে, সেটা যেন আমি সংগ্রহ করে পড়ি। এর পরের বছর অর্থাৎ ২০০৭ সালে তার সেই বইটি বের হয়, Glimpses Into The Corridors Of Power শিরোনামে। ঢাকায় বসে বহুকষ্টে বইটি জোগাড় করেছি। ফিল্ড মার্শাল আইয়ুব খানের শাসনামল থেকে শুরু করে জেনারেল পারভেজ মোশাররফের ক্ষমতা গ্রহণ পর্যন্ত সময়কালের গুরুত্বপূণর্ বহু তথ্য আছে বইটিতে।

ভুট্টোর শাসনামলে ধারাবাহিকভাবে একের পর এক, উল্লেখযোগ্য সব প্রতিপক্ষকে জেলে পাঠানো হয়। লাখ লাখ রাজনৈতিক কর্মীর বিরুদ্ধে দায়ের হয় মামলা। বিরোধী সব মত ও পথকে দমনের জন্য তৈরি করা হয়েছিল এফএসএফ-ফেডারেল সিকিউরিটি ফোর্স নামের বিশেষ পেটোয়া বাহিনী। তার পরও ভুট্টো স্বস্তিবোধ করছিলেন না। ১৯৭৭ সালে পার্লামেন্ট নির্বাচনের আগে তাই তিনি রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে নির্বাচনের বাইরে রাখার জন্য বিশেষ আদালত গঠন করেন। এই ট্রাইব্যুনালে ‘নাশকতা’, ‘সন্ত্রাস’, ‘রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে সশস্ত্র বিদ্রোহ’ ইত্যাকার অভিযোগ এনে গণহারে প্রতিষ্ঠিত রাজনীতিবিদদের অতিদ্রুত সাজা দেয়া শুরু হয়। ভাগ্যিস সে সময় ‘জঙ্গি’ শব্দটির উৎপত্তি হয়নি! ওই আদালত মুসলিম লীগের সিনিয়র নেতা চৌধুরী জহুর এলাহীকে তিনটি মহিষ চুরির মামলায় গ্রেফতার করে চার বছরের সাজা প্রদান করেছেন। গওহর আইয়ুব খানকে জনসভায় ভুট্টোবিরোধী কথা বলার জন্য ‘ডিফেন্স অব পাকিস্তান অ্যাক্টে’র আওতায় ‘ জনগণকে সরকারের বিরুদ্ধে উসকানি দেয়ার অভিযোগে’ পেশোয়ার জেলের ডেথ সেলের নির্জন কুঠরিতে আটকে রাখা হয়।

তার মামলার রায় হওয়ার কথা ছিল ১৯৭৭ সালের ৫ জুলাই। ভুট্টো বিশেষ আদালতের বিচারককে ব্যক্তিগতভাবে ফোন করে নির্দেশ দিয়েছিলেন গওহরকে সর্বোচ্চ সাজা প্রদান করার জন্য। এতে হয়তো তার ১৪ বছর কারাদণ্ড হয়ে যেত। অর্থাৎ রাজনৈতিক ক্যারিয়ার ওখানেই খতম! সিনিয়র নেতাদের এমন হেনস্তা প্রত্যক্ষ করে মুসলিম লীগের অন্য নেতারা চুপ মেরে যান। অনেকেই চাপে পড়ে যোগ দেন পিপিপি’তে। পরিণত হলেন ভুট্টোর বিশেষ খাদেমে। কিন্তু দৈবক্রমে রায় হওয়ার দিন ভোররাতেই সেনাপ্রধান জেনারেল জিয়াউল হক মার্শাল ল জারি করে ভুট্টোকে গ্রেফতার করেন। গওহর সকালে যথারীতি কোর্টে গিয়ে লক্ষ্য করেন সম্পূর্ণ ভিন্ন পরিবেশ। যে বিচারক তাকে ঠিক আগের দিন রূঢ় ভাষায় ‘পরিণতি ভোগ করার’ হুমকি দিয়েছিলেন, তিনিই গওহরকে চা অফার করেন। গওহর হতবাক। তিনি মামলার রায় দেয়ার কথা বললে বিচারক মুচকি হেসে বলেন, কিসের মামলা?

এবার জহুর এলাহীর ইস্যুটি দেখা যাক। ‘মহিষ চুরি’র অপরাধে তাকে চার বছর কারাদণ্ড দেয়ার বিষয়টিকে ব্যাখ্যা করা যায় এভাবে- প্রথমত, সরকারি দৃষ্টিকোণ থেকে জহুর এলাহী ‘চোর’, তা তিনি যাই চুরি করুন না কেন। চুরি করেছেন, তাই শাস্তি হয়েছে আইনানুযায়ী। আইন তার নিজস্ব গতিতে চলবে। এখানে বলার কী আছে? দ্বিতীয়ত, সাধারণ মানুষ ও সরকারবিরোধী দলের মতে জহুর এলাহী বংশগতভাবে বিশাল বিত্তবৈভবের অধিকারী। তিনি কিভাবে ও কেন তিনটি মহিষ চুরি করতে যাবেন? সরকার আইনের কথা বলে আসলে তাকে রাজনীতি থেকে দূরে সরিয়ে রাখছে এবং অন্যদের প্রতি মেসেজ দিচ্ছে, সরকারের বিরোধিতা করলে ওভাবে মহিষ বা মুরগি চুরির দায়ে হিউমিলিয়েট করা হবে! অতএব, নিজের মানসম্মান বাঁচাতে নীরব থাকুন। তৃতীয়ত, এ ক্ষেত্রে আইনের চেয়ে বড় হচ্ছে পাবলিক পারসেপশন বা জনগণের ধারণা। এজাতীয় খেলো ইস্যুতে প্রতিপক্ষকে হেনস্তা করা যায় ঠিকই, কিন্তু মানুষ কি তা বিশ্বাস করে? না। এমনকি সরকারি দলের মানুষ তা জানে, তবে ক্ষমতার স্বাদ আস্বাদনে সুবিধা হবে বলে এর সমর্থনে দাঁড়িয়ে যায়। রাজনীতি করতে হলে পাবলিক পারসেপশন বিশাল এক ফ্যাক্টর। যদি তা অবহেলা করা হয় তাহলে সরকারের প্রতি সৃষ্টি হয় তীব্র আস্থাহীনতা। নিরীহ জনগণ জেল-জুলুম, মামলা-মোকদ্দমার ভয়ে চুপসে গেলেও তাদের অন্তরে জমতে থাকে ঘৃণার পাহাড়।

প্রতিহিংসার রাজনীতি এবং প্রতিপক্ষকে ঘায়েল বা কোণঠাসা করে ক্ষমতায় থাকা বা ক্ষমতায় আসা চিরন্তন বাস্তবতা। অন্তত এই উপমহাদেশে তা অনেক ক্ষেত্রেই প্রকট। সাধারণ মানুষ গণতন্ত্র চায়; চায় মতপ্রকাশের স্বাধীনতা। ক্ষমতাসীনেরা দুর্নীতি কিংবা স্বৈরাচারী আচরণ করলে প্রতিবাদ করা স্বাভাবিক হয়ে দাঁড়ায়। একদলীয় শাসন তা যতই অর্থনৈতিক উন্নয়ন বা কথিত স্থিতিশীলতা বয়ে আনুক না কেন, বিরোধী মতকে স্তব্ধ করে দিলে এক সময় তা ব্যাকফায়ার করবেই। ইতিহাস এর সাক্ষী। ভুট্টো আইয়ুব খানের বেসিক ডেমোক্র্যাসি বা নিয়ন্ত্রিত গণতন্ত্র থেকে বেরিয়ে এসে ভোটের মাধ্যমে নির্বাচিত সরকার গঠনে সাধারণ মানুষকে উদ্বুদ্ধ করে তদানীন্তন পশ্চিম পাকিস্তানে সবচেয়ে জনপ্রিয় রাজনীতিবিদে পরিণত হয়েছিলেন। কল্পনাতীত কম সময়ে তার দল পিপিপি বা পাকিস্তান পিপলস পার্টি বৃহত্তম রাজনৈতিক দল হিসেবে আবির্ভূত হয়। ‘রুটি, কাপড়া আউর মাকান’, অর্থাৎ ‘রুটি, কাপড় ও বাসস্থান’- এই স্লোগান দিয়ে পিপিপি অধিকারবঞ্চিত মানুষের হৃদয়ে নাড়া দিয়েছিল। কিন্তু সেই দলই ক্ষমতায় এসে চেয়েছিল জেঁকে বসতে।

স্টিমরোলার চালিয়ে ভুট্টো নিস্তব্ধ করতে চেয়েছিলেন সব বিরোধী মতকে। এমনকি দলের মধ্যেও কোনো সমালোচনা তিনি সহ্য করতেন না। কেউ তার কথা বা সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে কোনো সমালোচনা করলেই তার ওপর নেমে আসত সরকারের বিভিন্ন বাহিনী ও সংস্থার খড়গ। এমনি একজন মানুষ ছিলেন আহমদ রাজা কাসুরি। তিনি ছিলেন পিপিপিরই একজন প্রখ্যাত নেতা ও সংসদ সদস্য। সংসদে ও মিডিয়ায় কয়েকবার ভুট্টোর কয়েকটি সিদ্ধান্তের তীব্র প্রতিবাদ করেছিলেন। এতেই ভুট্টো ক্ষেপে যান। তিনি মনে করেছিলেন, রাজা কাসুরি তার নেতৃত্বকে চ্যালেঞ্জ করছেন, যা প্রকারান্তরে ‘চেয়ারম্যান ভুট্টোকে’ অপমান করার শামিল। আশপাশের চাটুকার ও ‘অন্দরমহলের সিদ্ধান্ত গ্রহণকারীরা’ ভুট্টোকে কাসুরির বিরুদ্ধে আরো উসকে দেন। ভুট্টো ডেকে পাঠান বিশেষ পেটোয়া বাহিনী এফএসএফের প্রধান মাসুদ মাহমুদকে। নির্দেশ দেন ‘কী করতে হবে’। ক’দিন পর রাতে আহমদ রাজা কাসুরি ও তার পিতা একটি বিয়ের অনুষ্ঠানে যোগ দেয়ার পর গাড়িতে বাড়ি ফিরছিলেন। পথে এফএসএফ তার গাড়ি অ্যামবুশ করে। চালায় অটোম্যাটিক রাইফেল দিয়ে গুলি। যে কোনোভাবেই হোক, আহমদ রাজা কাসুরি বেঁচে যান। কিন্তু গুলিতে নিহত হলেন তার পিতা।

অনেক খুঁজে এই আহমদ রাজা কাসুরির সন্ধান পাই পাকিস্তান সরকারের আমন্ত্রণে সে দেশে এক সফরের সময় ২০০৪ সালে। আমার সাথে ওই সফরে সঙ্গী ছিলেন জাতীয় পার্টির প্রেসিডিয়াম সদস্য ও মুক্তিযোদ্ধা কাজী ফিরোজ রশিদ, সাবেক মন্ত্রী মোস্তফা জামাল হায়দার, সাবেক মন্ত্রী ও সাংবাদিক আনোয়ার জাহিদ, সংসদ সদস্য মরহুম ফজলুল হক আমিনী প্রমুখ। তখন একটি জাতীয় দৈনিকে বিশেষ সংবাদদাতা হিসেবে কাজ করছি। ইসলামাবাদ ক্লাবে দেখা করতে বললেন রাজা কাসুরি। তার সাথে চা খেতে খেতে সেই কুখ্যাত ঘটনার বিষয়ে অনেক কিছু জানতে পারলাম। তিনি জানান, আইয়ুব খানের শাসনামলের শেষ দিকে যখন ভুট্টোর নেতৃত্বে তীব্র আন্দোলন চলছে তখন ধড়িবাজ পুলিশ অফিসার মাসুদ মাহমুদ গওহর আইয়ুব খানের সাথে করাচিতে গোপনে দেখা করেন।

গওহর মাসুদ মাহমুদকে চিনতেন না। কী জন্য এসেছেন জানতে চাইলে মাসুদ মাহমুদ বলেন, যদি আইয়ুব খান তার নিরাপত্তার নিশ্চয়তা দিতে পারেন তাহলে তিনি ভুট্টোকে হত্যার ব্যবস্থা করতে পারেন। এ জন্য সব টেকনিক তার জানা। ভুট্টোকে হত্যা করলে ‘সব ঠিক হয়ে যাবে’ এবং আইয়ুব খান নিশ্চিন্তে থাকতে পারবেন ক্ষমতায়। গওহর এ কথা শুনে হতবাক হয়ে পড়েন। মাসুদ মাহমুদকে বের করে দেন বাড়ি থেকে। গওহর আইয়ুবের বইতেও ঘটনাটির উল্লেখ আছে। আহমদ রাজা কাসুরি দুঃখ করে বলেন, ক্ষমতায় এসে ভুট্টো সেই মাসুদ মাহমুদকেই বিশেষ বাহিনীর প্রধান বানিয়ে দেন চাটুকারদের কথায়। ভুট্টোর কাছের লোকেরা তাকে বলেছিল মাসুদ মাহমুদ ‘দলের লোক’, যা বলবেন তাই করবে। অত্যন্ত শঠ ও ধড়িবাজ এই কর্মকর্তা খুন, গুম, নির্যাতন করে খুব অল্প সময়েই ভুট্টোর প্রিয়ভাজনে পরিণত হন।

তিনি নিজে আহমদ রাজা কাসুরি হত্যা মিশনে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। এরপর জিয়াউল হক ক্ষমতায় এলে কী হলো? জানতে চাইলে রাজা সাহেব বলেন, কী আর হবে? ওই মাসুদ মাহমুদ তার বাবার হত্যাকাণ্ডের ঘটনার পুরো বিবরণ দিলেন কোর্টে। এ ছাড়া, বাকি অনেক হত্যাকাণ্ড ও অপকর্মে ভুট্টো কিভাবে এফএসএফ’কে ব্যবহার করেছেন তার ফিরিস্তিও তুলে ধরেন বিস্মিত বিচারকদের সামনে। সরকারের সাথে মাসুদ মাহমুদ চুক্তি করেন, তাকে যদি রাজসাক্ষী হওয়ার বদলে মাফ করে দেয়া হয় তাহলে তিনি সব ফাঁস করে দেবেন। তেলবাজ, কথিত ‘দলের লোক’ কর্মকর্তারা এমনই হন- দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন আহমদ রাজা কাসুরি। ভুট্টোর ফাঁসি হয়েছিল আহমদ রাজা কাসুরির পিতাকে হত্যার অপরাধে। প্রধান সাক্ষী ছিলেন মাসুদ মাহমুদ।

গওহর আইয়ুব খান ও ভুট্টো এক সময় ছিলেন ঘনিষ্ঠ বন্ধু। গওহরের মাকে ভুট্টোও মা বলে ডাকতেন। তিনি যখন বিয়ে করেন তখন ভুট্টোর স্ত্রী নুসরাত ভুট্টো তার নিজের বিয়েতে পাওয়া অলঙ্কার গওহরের স্ত্রী জেব কুলিখানকে উপহার দিয়েছিলেন। ১৯৭১ সালে ভারতের সাথে যুদ্ধ শুরু হলে নিজ উদ্যোগে গওহর তার রেজিমেন্টে যোগ দেন সম্মুখ সমরে অংশ নেয়ার জন্য। যুদ্ধের পর তার রেজিমেন্ট যে ভারতীয় এলাকা দখল করেছিল, তা দেখতে আসেন ভুট্টো। রণাঙ্গনে গওহরকে সামরিক পোশাকে দেখে তিনি অবাক হয়ে যান। প্রশ্ন করেন- হোয়াট আর ইউ ডুয়িং হিয়ার? গওহরের সোজাসাপ্টা উত্তর- দেশের জন্য যুদ্ধ করতে এসেছি। দুপুরে খাওয়ার পর গ্রুপ ছবি তোলার সময় সেনাপ্রধানসহ অন্যদের নিয়ে যখন ভুট্টো ছবি তুলতে যান, তখন দূরে দাঁড়িয়ে থাকা গওহরকে ডেকে নিয়ে আসেন। হাত ধরে টেনে নিজের পাশে দাঁড় করান। ব্যক্তিগত পর্যায়ে এই সৌজন্য তখনো ছিল। কিন্তু সেই ভুট্টোই কেন গওহরকে ডেথ সেলে নিক্ষেপ করলেন? কী এমন ঘটল? রাজনীতি, ক্ষমতার জৌলুশ, লালসার সিঁড়ি বেয়ে শুভবুদ্ধি ধাবিত হলো প্রতিশোধস্পৃহার দিকে। এ অবস্থায় সাধারণ বোধবুদ্ধি লোপ পেয়ে যায়। সীমালঙ্ঘনের পরিণতি মাথা থেকে যায় হারিয়ে। ইতিহাসের পাঠক শিক্ষিত মানুষও ভুলে যান ইতিহাসের শিক্ষা। চার পাশে দেখেও না দেখার ভান করেন। তবে ইতিহাস থমকে থাকে না। ইতিহাস থাকে ওঁৎ পেতে।

সৃষ্টিকর্তা যদি চাইতেন, তাহলে সবাইকে গায়ের রঙ এক করে দুনিয়াতে পাঠাতেন। এত ধর্ম ও অবিশ্বাসী কাউকে না পাঠিয়ে পাঠাতেন একটি মাত্র ধর্ম। তখন পৃথিবীতে থাকত শুধু বিশ্বাসীদের আবাস। সবার ভাষাই হতো একটা। কিন্তু মানবজাতির মধ্যে আছে নানা জাত, ধর্ম, বর্ণ, ভাষা এবং এসবের মাধ্যমেই বৈচিত্র্যের সৃষ্টি হয়েছে। সবাইকে মানিয়ে চলতে হয়। অপরের অধিকার ও মতকে ধারণ করতে হয়। সেটাই সৃষ্টিকর্তা নির্ধারণ করে দিয়েছেন। দেশ পরিচালনায় থাকতে হয় দরদমাখা শাসনের ছোঁয়া। যারা ক্ষমতায় থাকেন, তাদের থাকতে হয় ‘গণ্ডারের চামড়া’। কারণ, তাদেরই সহ্য করতে হয় সব সমালোচনা। ক্ষমতায় থাকলে সমালোচনা থাকবে, এটাই স্বাভাবিক। প্রতিপক্ষও থাকবে। এর মধ্যেই চলতে হবে। রাজনীতি কোনো অঙ্ক নয়। তবে এটা মানুষের অধিকার হরণের হাতিয়ারও হতে পারে না। অধিকার রক্ষা করাই রাজনীতির লক্ষ্য। ব্যত্যয় হলে প্রকৃতির নিয়মকেই অস্বীকার করা হয়। ইতিহাস তখনই ‘ঝাঁপিয়ে পড়ে’। আর আইনের শাসন থাকলে আইনকে ‘মহিষ চুরির’ পেছনে দৌড়াতে হয় না।

মূল উপসম্পাদকিয়-টি দৈনিক নয়াদিগন্ত-এর ০৭ ডিসেম্বর ২০১৮ প্রকাশ করা হয়েছিল।

মূল লিঙ্কঃ ক্ষমতার অলিগলিতে : কিছু আড়ালের কথা

Abu Rushd, Editor in Chief, Bangladesh Defence Journal
Editor in Chief at Bangladesh Defence Journal | Website |  + posts

Abu Rushd, the President of the Institute of Strategy and Tactics Research (ISTR), is a towering figure whose unparalleled experience spans military service, defense journalism, and global intelligence analysis. A former military officer turned investigative journalist, Abu Rushd brings over three decades of expertise in national security, international relations, and defense intelligence, making him an authoritative voice in shaping strategic discourse on global security challenges.

As a pioneer of defense journalism in Bangladesh, Abu Rushd has continuously pushed the boundaries of investigative reporting. He introduced defense and intelligence coverage into Bangladeshi media and established the Bangladesh Defence Journal, the country’s only publication dedicated to these critical issues. His in-depth understanding of intelligence agencies, military operations, and insurgency conflicts is reflected in his eight widely acclaimed books, with works cataloged in prestigious institutions like the University of Chicago, Yale University, and the University of Toronto.

Rushd's fearless journalism has taken him from the conflict zones of Sierra Leone to the reconstruction efforts in South Sudan. He has served as an official media partner at global defense expos, providing high-level analysis and insights into international security operations. His work on intelligence agencies, including his influential book on Indian espionage RAW in Bangladesh, stands as a testament to his commitment to uncovering hidden geopolitical forces.

As the President of ISTR, Lt. Abu Rushd's leadership reflects a rare combination of military precision, investigative rigor, and intellectual boldness. His visionary approach is essential for advancing strategic research that influences policy and shapes the future of global security.

Popular

Latest