‘অবিশ্বস্ত বন্ধুর চেয়ে প্রকাশ্য শত্রু অনেক শ্রেয়’- প্রাচীন প্রবাদ। ২০০৭ সাল। দৈনিক যায় যায় দিনে কাজ করি। ওয়ান-ইলেভেন জমানায় রিপোর্ট কী হবে, কতটুকু লেখা যাবে, কতটুকু যাবে না, কী লিখলে বিশেষ জায়গা থেকে ডাক পড়বে, কী লিখলে ‘ওয়াজিবুল কতল’ হতে হবে সেসব নিয়ে ভাবনায় দিন যায়। হঠাৎ একদিন সন্ধ্যায় প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের বড় সন্তান তারেক রহমান আমাদের অফিসে এলেন। সরাসরি চলে গেলেন সম্পাদক শফিক রেহমানের রুমে। কিছুক্ষণ পর পিওন এসে বলল কনফারেন্স রুমে যেতে। তারেক রহমান সিনিয়র সাংবাদিকদের সাথে কথা বলবেন। আমি রিপোর্টিংয়ে সিনিয়র মোস্ট। রওনা হলাম কনফারেন্স রুমের দিকে। কখন তারেক রহমান ও শফিক রেহমান ঠিক পেছনে চলে এসেছেন লক্ষ করিনি। তারেক রহমান হাত দিয়ে জড়িয়ে ধরলেন। মৃদু ক্ষোভের সাথে বললেন, রূশ্দ ভাই, আগের মতো সেই আগুনঝরা রিপোর্ট ও লেখা কোথায়? তিনি আমার হাত ধরে আছেন। কনফারেন্স রুমে গিয়ে টেবিলের যে প্রান্তে তার বসার কথা সেখানে পাশের চেয়ারে আমাকে বসতে বললেন। ওটা সম্পাদক শফিক রেহমানের বসার জন্য নির্ধারিত ছিল। আমি ওখানে বসতে চাইনি। তিনি জোর করে বসালেন। শফিক রেহমান চোখের ইশারায় সায় দিলেন।
তারেক রহমান বক্তব্য দিতে শুরু করলেন। ওয়ান-ইলেভেনের প্রেক্ষাপট, বিএনপির ভুলত্রুটি, বিরোধী দলের সহিংস আন্দোলন, লগি-বৈঠার তাণ্ডব সবই তার কথায় উঠে এলো। শক্তিশালী বিদেশী রাষ্ট্রগুলোর প্রসঙ্গ উল্লেখ করে দুঃখ করে তিনি বললেন, সন্ত্রাস দমনে এত সহযোগিতা করার পরও কয়েকটি দেশ আড়াল থেকে ওয়ান-ইলেভেন সংগঠনে পরোক্ষ ভূমিকা পালন করেছে। সবাই চুপচাপ শুনছেন। তার ওই কথায় ছন্দপতন ঘটালাম শিষ্টাচার লঙ্ঘন করে। বেশ ক্ষোভের সাথেই জানালাম, তারা যদি মনে করেন ও বুঝে থাকেন কয়েকটি বড় শক্তি কলকাঠি নেড়েছে তা হলে সময় থাকতে কেন অন্য একটি বিশ্বশক্তি যারা ব্যালান্স রক্ষা করতে পারে তাদের সহযোগিতা নেয়া হয়নি? তিনি মৃদু কণ্ঠে জানতে চাইলেন সেই শক্তি কোনটি? আমি বললাম, কেন? আপনার পিতা যেই চীনের সাথে দৃঢ় সামরিক ও কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন করে গেছেন তারা। তিনি হেসে দিলেন। বললেন, বিএনপির পাশে কি কেউ থাকে? কাউকে কি চোখ বন্ধ করে বিশ্বাস করা যায়? আমার আব্বা স্নায়ুযুদ্ধের সময় অনেক ঝুঁকি নিয়ে ভারত-সোভিয়েত অক্ষের বিরুদ্ধে চীনের সাথে সম্পর্ক তৈরি করেছিলেন। সেটি এ অঞ্চল তো বটেই, পৃথিবীর অনেক হিসাব-নিকাশ বদলে দিয়েছিল। তারই খেসারত তিনি জীবন দিয়ে দিয়েছেন। কাউকে তো পাশে পাওয়া যায়নি।
তর্ক আর বাড়াইনি। কথাগুলোয় যুক্তি আছে। পরদিন দৈনিক যায় যায় দিনে বড় করে তারেক রহমানের ছবি ছাপা হয় রিপোর্টসহ। আমি তার পাশে বসে আছি! ঘুম থেকে উঠতে না উঠতেই বিশেষ জায়গা থেকে বিশেষ ক্ষমতাধর কর্তার ফোন। ডেকে পাঠিয়েছেন। আমি পত্রিকায় চাকরি করি। আমার কী দোষ? তারেক রহমান আমার লেখা পছন্দ করেন, আমার কী অপরাধ? তিনি সম্মান দেখিয়ে পাশে বসিয়েছেন, আমার কী করণীয় ছিল? না। অনেক কটু কথা শুনতে হলো। আসার সময় শুধু বলে এলাম, তারেক রহমানের রাজনীতি নিয়ে এক শ’ একটা সমালোচনা করুন, কিন্তু তিনি জেনারেল জিয়ার ছেলে এটি অন্তত ভুলে যাবেন না। তার পিতার বদান্যতায় মাত্র সাড়ে তিন বছরে এক ডিভিশন শক্তির সেনাবাহিনী পাঁচ ডিভিশনে উন্নীত হয়েছিল। আর সে জন্যই বহু অফিসার ও সৈনিক নিতে হয়েছিল সেনাবাহিনীতে। আমাকে যে পদ ও পদবির জোরে বকছেন সেটাও ওই জেনারেল জিয়ার বদান্যতায় পাওয়া। শুরুটা তিনিই করে দিয়েছিলেন।
ওই ঘটনার ক’দিন পরই তারেক রহমান গ্রেফতার হন। জেনারেল জিয়ার দুই সন্তানকেই অবর্ণনীয় নির্যাতন সইতে হয়। তারেক রহমানের ব্যাকবোনের আঘাতজনিত জটিলতা এখনো আছে। অন্যজন আরাফাত রহমান কোকো তো সেই নির্যাতনের ফলোআপে ইহলোকই ত্যাগ করেছেন। বেশ বাহাদুরি! খোলাফায়ে রাশেদিনের সময়কার ‘সত্য যুগ’ কায়েমের উন্মত্ত বাহাদুরি! কিন্তু ওই একই বাহাদুররা আরো বহু কিছুই কিন্তু দেখেন, জানেন, তাদের তখন সাহস হয় না, সব ইঁদুরে পরিণত হন। যত বাহাদুরি সব দেখানো যায় বিএনপি নামের একটি দলের ওপর। যত দুর্নীতির খবর প্রকাশ করা যায় বিএনপি নামের একটি সরকারের বিরুদ্ধে। খাম্বা তত্ত্ব দেয়া যায়, বাংলা বা ইংরেজি ভাই দাঁড় করানো যায়, যত আজগুবি সব ব্যর্থতার কাহিনী প্রচার করা যায় বিএনপি নামের একটি জাতীয়তবাদী দলকে জড়িয়ে। টার্গেটটা কেন বিএনপি? কারণ মূল লক্ষ্য বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ। বারবার লক্ষ্য এই জাতীয়তাবাদ। ডান্ডাবাজি, মিথ্যাচার, চটকদারি, আরাম-আয়েশ ও মাতব্বরির কোনো ‘বাদ’ নয়।
এখন আসা যাক ওয়ান-ইলেভেন বিতর্কে। এখানে বহুজন ইতোমধ্যেই বহু তথ্য, ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা উপস্থাপন করেছেন। তাই সেসব নিয়ে কথা নয়। বরং দেখা যাক সেনাপ্রধান নিয়োগ নিয়ে অবিরাম চলতে থাকা ইস্যুটি কতটা যৌক্তিক? অনেকে বলেন বা অভিযোগ করেন যে, বিএনপি তার শাসনামলে সেনাপ্রধান নিয়োগ দেয়ার সঠিক সিদ্ধান্ত নেয়নি বলে ওয়ান-ইলেভেনের ঘটনাটি ঘটেছে বা আরোপিত হয়েছে। জেনারেল মইন উ আহমদকে নিয়োগ দেয়াটা সঠিক ছিল না। তিনি ‘বিশ্বাসঘাতকতা’ করেছেন। যেহেতু তদানীন্তন বিএনপি সরকার সাতজন সিনিয়রকে ডিঙ্গিয়ে জেনারেল মইনকে সেনাপ্রধান করেছিল তাই দায় বিএনপির। হ্যাঁ, এ দেশের সব ‘অপকর্মের’ দায় কেবলই বিএনপির! সব ভালো কাজের বাহ্বা অন্যদের!
এ কথা সত্য যে, তদানীন্তন মেজর জেনারেল মইনকে সেনাপ্রধান নিয়োগ দেয়াটা অনেককেই বিস্মিত করে। সেনাবাহিনীতে শুধু সিনিয়রিটি দেখে সেনাপ্রধান নিয়োগ করা হয় না। যোগ্যতা একটি বড় ব্যাপার। আর সেসময় যোগ্যতার মাপকাঠিতে সঙ্গত কারণেই এগিয়ে ছিলেন ৪৫তম পিএমএ লং কোর্সের অফিসার মেজর জেনারেল রেজ্জাকুল হায়দার, ৪৭তম পিএমএ লং কোর্সের মেজর জেনারেল ফজলে এলাহী আকবর, মুক্তিযোদ্ধা মেজর জেনারেল জামিল ডি আহসান, বীর প্রতীক ও জেনারেল মইনের কোর্সমেট মেজর জেনারেল জহির যিনি ছিলেন প্রথম শর্ট সার্ভিস কমিশনের সিনিয়র মোস্ট কর্মকর্তা। তাদের সবাই সেনাবাহিনীতে অত্যন্ত সম্মানিত ও যোগ্যতর কমান্ডার হিসেবে পরিচিত ছিলেন। প্রাপ্ত তথ্যানুযায়ী, সরকার এই চারজনের মধ্য থেকে মেজর জেনারেল রেজ্জাকুল হায়দারকে সেনাপ্রধান নিয়োগের সিদ্ধান্ত পাকা করেন ও তাকে সে অনুযায়ী অবহিতও করা হয়। কিন্তু কোনো এক অজ্ঞাত কারণে বেগম খালেদা জিয়ার ছোট ভাই অবসরপ্রাপ্ত মেজর সাইদ ইস্কান্দারের কোর্সমেট মেজর জেনারেল মইন উ আহমদকে নিয়োগ দেয়া হয়।
তখন বলা হয়, এ ধরে পাকিস্তান মিলিটারি একাডেমি থেকে কমিশনপ্রাপ্ত অফিসারদের সেনাপ্রধান হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়েছে। বাংলাদেশ মিলিটারি একাডেমি থেকে কমিশনপ্রাপ্ত কাউকে নিয়োগ দিলে বিএনপির নাম স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে। যদিও মেজর জেনারেল জামিল ডি আহসান পাকিস্তান মিলিটারি একাডেমি থেকে কমিশনপ্রাপ্ত ছিলেন না। বরং তিনি মুক্তিযুদ্ধের সময় ভারত থেকে কমিশন লাভ করেন। বাংলাদেশ কমিশন্ড কাউকে নিয়োগ দেয়া ভালো যুক্তি। কিন্তু তাহলে মুজিব আমলে কমিশনপ্রাপ্ত একই কোর্সের প্রথম অফিসার জেনারেল জহিরকে বাদ দেয়া হলো কেন? এমন অনেক প্রশ্ন অনেকের মনে ঘুরে বেড়িয়েছে ও বেড়াচ্ছে। জেনারেল মইন সেনাবাহিনীতে অফিসার ও সৈনিকদের মধ্যে ভিনডিকটিভ হিসেবে পরিচিত ছিলেন। তার পরও তিনি জেঁকে বসলেন! পর্দার আড়ালে কলকাঠিটা আসলে কে নেড়েছিল? সেনাপ্রধান হিসেবে নিয়োগ পাওয়ার আগে জেনারেল মইনকে সেনা সদর দফতরে সিজিএস করে নিয়ে আসা হয়। ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসে তাকে পাঠিয়ে দিয়েছিল পাকিস্তানে প্রতিরক্ষা উপদেষ্টা হিসেবে। তিনি হয়েছিলেন উপেক্ষিত, পদোন্নতিবঞ্চিত।
যাই হোক, ওয়ান-ইলেভেন যখন হয় ও এর ক্রীড়নক যারা ছিলেন তাদের প্রায় সবাই ছিলেন বিএনপি ঘরানার এবং বিএনপি সরকারের প্রত্যক্ষ সুবিধাপ্রাপ্ত। অন্তত পদোন্নতির ক্ষেত্রে কয়েকজন ভালোই সুবিধা পেয়েছিলেন। লে. জেনারেল মাসুদ উদ্দিন চৌধুরী যিনি ওয়ান-ইলেভেন সংঘটনে অত্যন্ত সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন ও গুরুতর অপরাধ দমন কমিটির নামে ইলেকট্রিফাইয়িং তৎপরতা চালান; তিনি ছিলেন সাভারস্থ নবম পদাতিক ডিভিশনের জিওসি। ২০০১ সালে যখন বিএনপি ক্ষমতায় আসে তখন আওয়ামী আমলে কোণঠাসা ও সুপারসিডেড কর্নেল মাসুদ উদ্দিনকে জরুরি ভিত্তিতে ডিজিএফআইয়ে পরিচালক-সিআইবি হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়। অতি অল্প সময়ের মধ্যে তিনি ব্রিগেডিয়ার জেনারেল হিসেবে পদোন্নতি পান। বলতে গেলে তার পরামর্শেই ২০০২ সালে পরিচালনা করা হয় ‘অপারেশন ক্লিনহার্ট’। র্যাব গঠনের মৌলিক ধারণাও তার দেয়া। সে সময় ডিজিএফআইয়ের সবচেয়ে প্রভাবশালী রক্ষীবাহিনীর এই সাবেক কর্মকর্তাকে আবার দ্রুত মেজর জেনারেল হিসেবে পদোন্নতি দেয় বিএনপি। পারিবারিক সম্পর্কে তিনি মেজর সাইদ ইস্কান্দারের আপন ভায়রা! ওয়ান-ইলেভেনের পর জেনারেল মইন তাকে কমান্ড থেকে সরিয়ে দেন কৌশলে। লেফটেন্যান্ট জেনারেল হিসেবে পদোন্নতি দিয়ে মাসুদ উদ্দিনকে বদলি করা হয় আর্মড ফোর্সেস ডিভিশনে পিএসও হিসেবে। তবে ‘গুরুতর’ সব ‘অপরাধ’ দমন থাকে তার নিয়ন্ত্রণে।
আরেক আলোচিত নাম মেজর জেনারেল এ টি এম আমিন। সেনাবাহিনীতে তিনি বিহারি আমিন বলে পরিচিত। ওয়ান-ইলেভেনের সময় ব্রিগেডিয়ার জেনারেল হিসেবে ছিলেন ডিজিএফআইয়ের কাউন্টার টেররিজম ব্যুরো-সিটিআইবির পরিচালক। তাকে সবাই জোট সরকারের অন্যতম মিত্র একটি দলের ঘনিষ্ঠ বলে জানত। সন্ত্রাসবিরোধী তৎপরতার সাথে জড়িত ছিলেন বলে তার ছিল সব বিদেশী গোয়েন্দা সংস্থার সাথে একান্ত সখ্যতা। নাইন-ইলেভেনের পর যুক্তরাষ্ট্র যখন কাউন্টার টেররিজম নিয়ে উতলা হয়ে ওঠে তখন এই ব্রিগেডিয়ার এ টি এম আমিন পরিণত হন সেই কর্মযজ্ঞের মূল স্তম্ভে। অস্বীকার করার উপায় নেই, ডিজিএফআইয়ের সিটিআইবি সন্ত্রাস মোকাবেলায় গঠিত হয় ও বিভিন্ন ক্ষেত্রে সাফল্য অর্জন করে। যুক্তরাষ্ট্রসহ ‘ফাইভ আইস’ভুক্ত দেশগুলো অর্থাৎ অস্ট্রেলিয়া, গ্রেট ব্রিটেন, জাপান, নিউজিল্যান্ড সন্ত্রাসবিরোধী তৎপরতাকে জোরদার করতে সে সময় সেনা কর্মকর্তাদের বিভিন্ন দেশে প্রশিক্ষণ দেয়। র্যাব গঠনের একটি বড় অ্যালিবাই ছিল জঙ্গি দমন, সাথে অভ্যন্তরীণ অপরাধ নিয়ন্ত্রণ। র্যাব গঠনের সময় বিএনপির প্রায় সব সিনিয়র নেতা বিরোধিতা করেছিলেন। কিন্তু কয়েকজন অতিউৎসাহী ও ‘ব্রাইট আইডিয়াধারী’ কর্মকর্তার লম্ফঝম্ফ জয়ী হয় ও সরকার র্যাব গঠনে এগিয়ে যায়। তখন এমন একটি ধারণা দেয়া হয়েছিল, র্যাব গঠন করলে দেশ শান্তির আবাসে পরিণত হবে। বাঘ রক্তের স্বাদ একবার পেলে আর কি পিছু ফিরে চায়? কেউ সেই আপ্তবাক্যটি মনে রাখেনি। এ দিকে ডিজিএফআইয়ে বসে ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আমিন যেসব অতি তৎপরতা চালাতেন সেখানে তার ডান হাত ছিল লে. কর্নেল জোয়ারদার। সরকারের সব মহলে ছিল তার অবাধ বিচরণ ও প্রভাব। কারণ তিনিও ছিলেন বেগম জিয়ার আত্মীয়। লে. কমান্ডার ডিউকের ভায়রা। ওয়ান-ইলেভেন হলে দেখা যায় ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আমিন অতি সক্রিয়, অতিমাত্রায় ধ্বংসযজ্ঞে লিপ্ত। কর্নেল সাইফ জোয়ারদার রুহানী দুরবিন দিয়ে খুঁজে বেড়াচ্ছেন কোথায় বিএনপি?
ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ফজলুল বারী আরেক পরিচিত নাম। তার নির্দিষ্ট কোনো রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতা না থাকলেও তিনি ছিলেন কট্টর জাতীয়তাবাদী একজন অফিসার। সৎ হিসেবে বিডিআরে থাকাকালীন কিংবদন্তিতে পরিণত হয়েছিলেন। আওয়ামী সরকারের সময় উপেক্ষিত এই কর্মকর্তা বিএনপি আসার পর ডিজিএফআইতে নিয়োগপ্রাপ্ত হন। তারও পদোন্নতি হয়। র্যাব গঠনের সময় এডিশনাল ডিজি হিসেবে তিনি দাগী অপরাধী দমনে বিশেষ ভূমিকা রাখেন। ওয়ান-ইলেভেন যেদিন সংঘটিত হয় সেদিন তিনি ছিলেন ডিজিএফআইয়ের ভারপ্রাপ্ত ডিজি। মূল ডিজি মেজর জেনারেল সাদিক হাসান রুমী তখন ব্রিটেনে কোনো এক সেমিনার নিয়ে ব্যস্ত। তিনি হয়তো জানতেও পারেননি (বা জেনেও জানতেন না) আকাশে মেঘের কতটা ঘনঘটা? মেজর জেনারেল রুমীও ছিলেন জে. মইন ও সাইদ ইস্কান্দারের কোর্সমেট! দীর্ঘ পাঁচ বছর ছিলেন ডিজিএফআইয়ের মহাপরিচালক!
অবসরপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল এম এ মতিন, বীর প্রতীককে বলা হয় ওয়ান-ইলেভেন সংঘটনকারীদের মুরব্বি। জেনারেল মইন ও মেজর জেনারেল মাসুদের মধ্যে যখন ওয়ান-ইলেভেনের মোডাস অপারেন্ডি নিয়ে দ্বিমত ছিল তখন মেজর জেনারেল মতিন তাদের মধ্যে সমঝোতা করে দেন গোপনে। তিনি বিএনপি শাসনামলে দুর্নীতি দমন ব্যুরোর মহাপরিচালক হিসেবে ব্যাপক সফলতা লাভ করেন। এর আগে বাংলাদেশের ইতিহাসের এক ক্রান্তিকালে ১৯৯৬ সালের ২০ মে ডিজিএফআইয়ের ডিজি হিসেবে অবিস্মরণীয় ভূমিকা পালন করে সেনা অভ্যুত্থান মোকাবেলা করেন। অত্যন্ত সাহসী, দেশপ্রেমিক ও সৎ এই জেনারেল ছিলেন প্রেসিডেন্ট জিয়ার শাসনকালে পিজিআরের প্রথম কমান্ডিং অফিসার। সে সময় এসএসএফ ছিল না বিধায় পিজিআরকেই মূলত প্রেসিডেন্টের নিরাপত্তার দায়িত্ব পালন করতে হতো। জেনারেল জিয়ার অত্যন্ত স্নেহভাজন হওয়া ছাড়াও তিনি তার স্ত্রীর দিক দিয়ে বেগম জিয়ার পরিবারের সাথে আত্মীয়তার বাঁধনে বাঁধা। ২০০১ সালে বিএনপি ক্ষমতায় আসার পর জেনারেল মতিনকে এনএসআই-জাতীয় নিরাপত্তা গোয়েন্দার ডিজি হিসেবে সিলেক্ট করা হয় ও সে অনুযায়ী তাকে জানিয়েও দেয়া হয়। কিন্তু সেখানেও নিয়োগ পান সাইদ ইস্কান্দারের আরেক কোর্সমেট মরহুম ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আবদুর রহিম।
ওয়ান-ইলেভেন সরকারের একজন প্রভাবশালী উপদেষ্টা অবসরপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল গোলাম কাদেরও ছিলেন বিএনপির ঘনিষ্ঠ। ১৯৯১ সালে বিএনপি ক্ষমতায় আসার পর এনএসআইয়ের ডিজি হিসেবে প্রথম নিয়োগ পান মরহুম ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আমিনুল হক, বীর উত্তম। তার পর ওই পদে বসেন মেজর জেনারেল গোলাম কাদের। ২০০১ সালে বিএনপি আবার ক্ষমতায় এলে তাকে সরকার বিভিন্ন পরামর্শ প্রদানে নিবিড়ভাবে কাজে লাগায়।
আরেকজন শীর্ষ কর্মকর্তার নাম এ ব্যাপারে প্রত্যক্ষভাবে না এলেও তার বিশেষ ভূমিকা বা সিদ্ধান্তের কথা বলতে হয়। তিনি হলেন সাবেক সেনাপ্রধান ও সে সময়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা লে. জেনারেল হাসান মাশহুদ চৌধুরী। অত্যন্ত সৎ ও পেশাদার জে. মাশহুদকে বিএনপি বেশ নাটকীয়তার মধ্য দিয়ে সেনাপ্রধান নিয়োগ করে। লে. জেনারেল হারুনকে আওয়ামী লীগ সেনাপ্রধান নিয়োগ করার সময় তার চেয়ে সিনিয়র মেজর জেনারেল মাশহুদকে বাহরাইনে রাষ্ট্রদূত করে পাঠিয়ে দিয়েছিল। বিএনপি ক্ষমতায় এসে গোপনে জেনারেল মাশহুদকে বাহরাইন থেকে উড়িয়ে নিয়ে এসে সেনাপ্রধান নিযুক্ত করে। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা থাকাকালে বিরোধী দলগুলোর অনমনীয় ধ্বংসাত্মক আন্দোলনের সময় তিনি হঠাৎ করে পদত্যাগ করে বসেন। তার এই অকস্মাৎ পদত্যাগ ওয়ান-ইলেভেনের পথকে সুগম করে তোলে।
এখন প্রশ্ন হলো- এত সব জাতীয়তাবাদী ও বিএনপি নেতৃত্বের আত্মীয়, বন্ধু-বান্ধব সেনা কর্মকর্তা কেন ওয়ান-ইলেভেনের সাথে জড়িয়ে গেলন? এটা কি পারসোনাল ভ্যানডেটা, অভ্যন্তরীণ কোন্দল, ব্যক্তিস্বার্থ, বৈদেশিক চাপ নাকি ভিন্ন কিছু? এ ব্যাপারে রাজনৈতিক, আন্তর্জাতিক ইস্যু নিয়ে বহু মত প্রকাশ করা হয়েছে ও হচ্ছে। দৃশ্যমান বড় কারণ হিসেবে প্রায় সবাই উল্লেখ করেন যে, জাতিসঙ্ঘ মিশনে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর মিশন বাতিল করার চিঠি পেয়ে বা ভুয়া চিঠি বানিয়ে তদানীন্তন সেনা কর্তৃপক্ষ ওয়ান-ইলেভেনকে জায়েজ করেছে। ভালো কথা! আশ্চর্য ব্যাপার এরপর এই জাতির ওপর দিয়ে কত ঝড় বয়ে গেল, কত কিছু হলো, একপক্ষীয় নির্বাচন হলো, অর্ধেকের বেশি বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় সংসদ সদস্য নির্বাচিত হলেন, সাবেক প্রধানমন্ত্রীকে বালুর ট্রাক দিয়ে অসভ্যের মতো আটকে রাখা হলো, কই কেউ তো কিছু আশঙ্কা করলেন না! স্পিকি টু নট! একেবারে নিশ্চুপ!
জেনারেল মইনকে সেনাপ্রধান নিয়োগ করার ‘দোষ’ বিএনপির! ঠিক আছে। এর আগের নিয়োগগুলো কী? পরেরগুলোই বা কী? আওয়ামী লীগ সরকার কি কোনো সিনিয়রিটি ব্রেক করেনি? অতি বিশ্বস্ত কর্মকর্তাকে নিয়োগ দেয়নি? এসব নিয়ে কথা কোথায়?
জেনারেল জিয়া সেনাপ্রধান করেছিলেন পাকিস্তান প্রত্যাগত লে. জেনারেল হোসেইন মুহম্মদ এরশাদকে। চেইন অব কমান্ড বজায় রাখতেই এরশাদকে সেনাপ্রধান বানানো হয়। তিনি সেই চেইন অব কমান্ড এমনি বজায় রাখলেন যে, আটঘাট বেঁধে নির্বাচিত বিএনপি সরকারকে হটিয়ে দিলেন, দল হিসেবে বিএনপিকে ছিন্নভিন্ন করলেন। অনেকে বলেন, সে সময় জেনারেল জিয়া যদি মুক্তিযোদ্ধা কাউকে সেনাপ্রধান হিসেবে নিয়োগ দিতেন তা হলে অমন ঘটনা ঘটত না। তাই? তা হলে জিয়ার শাসনামলে ২১টি সেনা অভ্যুত্থান করেছিল কারা? ওসবে কি কোনো মুক্তিযোদ্ধা অফিসার জড়িত ছিলেন না? জিয়াউর রহমানকে হত্যা করে কে বা কারা? হত্যাকারীদের সবাই মুক্তিযোদ্ধা। এমনকি জিয়ার বিশ্বস্ত পিএস কর্নেল মাহফুজও ছিলেন সেসব হত্যাকারীর একজন। তাহলে? গলদটা অন্য জায়গায়।
এরশাদ পতনের পর নানা পক্ষ থেকে চাপ দেয়া হলো, বলা হলো মুক্তিযোদ্ধা কাউকে সেনাপ্রধান নিয়োগ দিলে সব মুশকিল আসান হয়ে যাবে। চার দিকে ধন্য ধন্য পড়ে যাবে। বিএনপি তাই করল। একজন বীর বিক্রমকে সেনাপ্রধান করা হলো। অভিযোগ আছে, তিনিও বিএনপির পা ভেঙে দিতে চেয়েছিলেন। ১৯৯৬ সালে ক্যু করে রীতিমতো হইচই ফেলে দিয়েছিলেন।
পাকিস্তান প্রত্যাগত, মুক্তিযোদ্ধা, বাংলাদেশ কমিশন- সবই তো পরীক্ষা করা হয়েছে! সবাই বিএনপি বধ কাণ্ডে জড়িয়ে গেছে। বিস্ময়কর নয় কি? এসবকে কী বলা যাবে? সব রাগ, অনুরাগ, পরীক্ষা-নিরীক্ষা কেন বিএনপির ওপর?
সেনাপ্রধান যারা ছিলেন তাদের মধ্যে যারা রাজনীতি করেছেন বা এর সাথে জড়িয়েছেন, একজন ছাড়া সবাই আওয়ামী মহলে যুঁথবদ্ধ হয়েছেন কিভাবে? মেজর জেনারেল শফিউল্লাহ, লে. জেনারেল নুরউদ্দিন খান, জেনারেল মোস্তাফিজ সরাসরি আওয়ামী লীগের নেতা, সংসদ সদস্য ও মন্ত্রী ছিলেন। লে. জেনারেল হারুন কোন পক্ষের হয়ে প্রকাশ্যে জেনারেল জিয়াকে নিয়ে কটূক্তি করে অবিরাম কথা বলেন? বাকিদের নাম বলছি না। একমাত্র জেনারেল মাহবুব ছাড়া কেউ বিএনপির সাথে যাননি! কেউ অভিযোগ করেন, কোনো একজনকে নাকি নমিনেশন না দেয়ায় তিনি আওয়ামী লীগে ভিড়ে যান। তার মানে নমিনেশনটাই মুখ্য, আদর্শটা নয়। এ যুক্তিটা কি খুব পোক্ত?
বিএনপির দোষ অনেক! সবচেয়ে বড় দোষ- বিশ্বাস করা! কাকে বিশ্বাস করবে? একে বানালে সব ঠিক, ওকে বানালে বিশ্বস্ততার ঢেউ বয়ে যাবে; এসব কি খুব বিশ্বাস করা যায় আর? কেউ কথা রাখেনি। হাস্যকর সব অজুহাত দেয় একেকজন। কেউ কি স্বপ্নেও চিন্তা করতে পারেন যে, বঙ্গবন্ধুর খুনি ফারুক, রশিদ গংয়ের কারো সন্তানকে আওয়ামী লীগ সরকার সশস্ত্রবাহিনীতে অফিসার হিসেবে কমিশন পেতে দেবে বা থাকতে দেবে? না। কিন্তু জেনারেল জিয়ার হত্যাকারী যাদের ফাঁসি হয়েছিল তাদের দু’জনের সন্তান ঠিকই বিএনপির কোনো শাসনামলে সশস্ত্রবাহিনী থেকে চাকরিচ্যুত হননি, বহাল তবিয়তেই ছিলেন।
এ দিকে আরো বড় সমস্যা, বিএনপি হুতুম করে গলায় টিপে ধরতে শেখেনি, ডান্ডাবাজির কৌশল রফত করতে পারেনি, কাঁটা দিয়ে কাঁটা তুলতে ঠিকমতো প্রশিক্ষণ পায়নি।
আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও দলটির বন্ধু বলে যারা পরিচিত তারাও সব ধরি মাছ না ছুই পানি জাতীয়। যে চীন বিএনপির প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে বন্ধু হিসেবে প্রমিনেন্ট, যেই বিএনপির জন্য চীন বাংলাদেশের মাটিতে কৌশলগত, সামরিক হাত প্রসারিত করতে পেরেছে সেই চীন কখনোই বিএনপির বিপদে পাশে এসে দাঁড়ায়নি। ওয়ান-ইলেভেনের জন্ম হয়েছিল ভারত-মার্কিন-ইইউ অক্ষের মাধ্যমে। তারা ঠিকই শক্তভাবে কাজ করে ছেড়েছে। বিএনপিপন্থী, জিয়া পরিবারের আত্মীয়দের দিয়ে বিএনপিকে তছনছ করেছে। চীন তখন শুধু তাকিয়ে দেখেছে। টুঁ শব্দটি করেনি, পাশে এসে দাঁড়ানো তো দূরে থাক।
ওয়ান-ইলেভেনের পর ভারতীয় পত্রপত্রিকায় অব্যাহতভাবে লেখা হতে থাকে একটি কথা- বাংলাদেশকে চীনের ছাতার নিচ থেকে বের করে আনতে হবে। আর চীনের ছাতা হলো বিএনপি। তাই টার্গেট হয় বিএনপি। চীন একবারও তাদের সেই কৌশলগত পার্টনার বিএনপির জন্য কোনো সহানুভূতি প্রকাশ করেনি। চেয়ে চেয়ে দেখেছে। ২০০৯ সাল থেকে হাজির করেছে আজব এক তত্ত্ব- বাংলাদেশকে হাতে রাখতে হবে। ইতিহাস এক দিন বলবে চীন বাংলাদেশকে কতটুকু হাতে রাখতে পেরেছে? এখানে তাইওয়ান ইস্যু তুলে লাভ নেই। ওটার জন্য বেগম জিয়া নিজে দুঃখপ্রকাশ করেছিলেন। তত্ত্বকথা বহু বলা হয়েছে ও হচ্ছে। অন্য পক্ষ নিয়ে কেউ কোনো তত্ত্বকথা তো দূরে থাক ‘ত’ বর্ণটিও উচ্চারণ করতে পারেন না। বাস্তবতা হলো- চীনের ছাতা হওয়াটাই হয়েছে বিএনপির যত কাল। ওয়ান-ইলেভেন সে জন্যই হয়েছিল। সবাই দাবড়িয়েছিল বিএনপিকে।
দোষ তো বিএনপির! কাকে বিশ্বাস করবে?
বিএনপিকে গালি দেয়া সহজ, বিএনপিকে পাকিস্তানপন্থী বলা সহজ, বিএনপিকে দুর্নীতিবাজ বলা সহজ, বিএনপির নেতাকর্মীদের পিটুনি দেয়া সহজ, গুম করা জায়েজ, ক্ষমতার বাইরে রাখা ওয়াজিব! কারণ বিএনপির বিশেষ অর্থে পরিচালিত মিডিয়া নেই, লাঠিয়াল নেই, মাসলম্যান নেই; যা ছিল সেগুলোও র্যাবের হাতে খতম হয়ে গেছে প্রথম ধাক্কাতেই। অন্য দলগুলোর সব কিন্তু ইনট্যাক্ট আছে।
কেন বিএনপি রাস্তায় টিকতে পারে না সেটা জোরে বলাও সহজ, ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ করা হ্যাবিচ্যুয়াল হ্যাবিট। কিন্তু ব্যালান্সটা যে ‘বিশ্বাসীরাই’ শেষ করে দিয়ে গেছে সেটা বলা সহজ নয়!
মূল উপসম্পাদকিয়-টি দৈনিক নয়াদিগন্ত-এর ২৩ জানুয়ারি ২০২২ প্রকাশ করা হয়েছিল।
মূল লিঙ্কঃ কাকে বিশ্বাস করবে বিএনপি
Abu Rushd, the President of the Institute of Strategy and Tactics Research (ISTR), is a towering figure whose unparalleled experience spans military service, defense journalism, and global intelligence analysis. A former military officer turned investigative journalist, Abu Rushd brings over three decades of expertise in national security, international relations, and defense intelligence, making him an authoritative voice in shaping strategic discourse on global security challenges.
As a pioneer of defense journalism in Bangladesh, Abu Rushd has continuously pushed the boundaries of investigative reporting. He introduced defense and intelligence coverage into Bangladeshi media and established the Bangladesh Defence Journal, the country’s only publication dedicated to these critical issues. His in-depth understanding of intelligence agencies, military operations, and insurgency conflicts is reflected in his eight widely acclaimed books, with works cataloged in prestigious institutions like the University of Chicago, Yale University, and the University of Toronto.
Rushd's fearless journalism has taken him from the conflict zones of Sierra Leone to the reconstruction efforts in South Sudan. He has served as an official media partner at global defense expos, providing high-level analysis and insights into international security operations. His work on intelligence agencies, including his influential book on Indian espionage RAW in Bangladesh, stands as a testament to his commitment to uncovering hidden geopolitical forces.
As the President of ISTR, Lt. Abu Rushd's leadership reflects a rare combination of military precision, investigative rigor, and intellectual boldness. His visionary approach is essential for advancing strategic research that influences policy and shapes the future of global security.