Homeবাংলা শাখাইতিহাসের ভুলে যাওয়া অধ্যায় : আফগানিস্তানে সোভিয়েত আগ্রাসন

ইতিহাসের ভুলে যাওয়া অধ্যায় : আফগানিস্তানে সোভিয়েত আগ্রাসন

‘God will not forgive us if we fail’- Leonid Brezhnev
‘যদি আমরা ব্যর্থ হই তাহলে ঈশ্বর আমাদের ক্ষমা করবেন না’ বলেছেন ১৯৭৯ সালে আফগানিস্তানে সামরিক আগ্রাসন চালানোর প্রাক্কালে সৃষ্টিকর্তায় ও ধর্মে অবিশ্বাসী সমাজতান্ত্রিক সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রেসিডেন্ট লিওনিদ ব্রেজনেভ।

১৯৭২ সালের ৭ সেপ্টেম্বর সন্ধ্যায় ছয়জন আগন্তুক হাজির হলো মোনাহাজউদ্দিন গাহিজের কাবুলের বাড়িতে। গাহিজ ছিলেন মুসলিম বিশ্বের সে সময়কার উল্লেখযোগ্য কমিউনিস্টবিরোধী বুদ্ধিজীবী ও একটি জনপ্রিয় পত্রিকার সম্পাদক। তিনি অব্যাহতভাবে আরব ও মুসলিম বিশ্বে সোভিয়েত গুপ্তচর সংস্থার নাশকতামূলক কর্মকাণ্ড ও মগজ ধোলাইয়ের ব্যাপারে সতর্কবাণী উচ্চারণ করে আসছিলেন। তার পত্রিকায় আফগানিস্তানের রাজনীতি, প্রশাসন, গোয়েন্দা সংস্থা, সামরিক বাহিনীতে সোভিয়েত অনুপ্রবেশ ও প্রভাব নিয়ে বহু অনুসন্ধানী প্রতিবেদন নিয়মিত প্রকাশিত হতো। এজন্য অজ্ঞাত ব্যক্তিরা বহুবার তাকে ফোন করে হুমকি ও হত্যার হুঁশিয়ারি দিয়েছে। ওই দিন ঠিকই গুপ্তঘাতকের দল তার বাড়িতে হাজির হয়। ছয়জনের মধ্যে দু’জন ঘরে ঢোকে এবং শেষবারের মতো গাহিজকে সোভিয়েতবিরোধী লেখালেখি থেকে বিরত থাকার জন্য চাপ দেয়। তিনি স্বভাবসুলভভাবেই তা প্রত্যাখ্যান করেন। তখন ঘাতকরা অস্ত্র বের করে গুলি ছোড়ে। এতে তিনি, তার ভাতিজা নিহত হন আর উপস্থিত একজন মেহমান আহত হন।

‘কেজিবি : দি সিক্রেট ওয়ার্ক অব সোভিয়েত সিক্রেট এজেন্টস’ শিরোনামে জন ব্যারন লিখিত বইয়ে গাহিজের হত্যাকাণ্ডের উল্লেখ করা হয় সবিস্তারে। পৃথিবীখ্যাত প্রকাশনা সংস্থা ব্যানটাম বুকস থেকে ১৯৭৪ সালে প্রকাশিত হয় এই বইটি কেজিবির ওপর লেখা অন্যতম রেফারেন্স হিসাবে স্বীকৃত। আরো জানা যায়, সোভিয়েত ঘাতকরা ইচ্ছাকৃতভাবেই হত্যাকাণ্ডটিকে নৃশংস রূপ দেয় এবং সোভিয়েত ইউনিয়নে তৈরি করা গুলির খোসাসহ অন্যান্য আলামত রেখে যায় যাতে যে কেউ বুঝতে পারে, ওই হত্যাকাণ্ড ছিল সোভিয়েত ইউনিয়নের বিরুদ্ধে লেখার খেসারত।

গাহিজ হত্যাকাণ্ডের পর কাবুলে সোভিয়েত রাষ্ট্রদূত সের্গেই পেত্রোভিচ কিকটেভ হুট করে এবং ক‚টনৈতিক রীতিনীতি ভঙ্গ করে আফগানিস্তান ত্যাগ করেন। এ ঘটনা নিয়ে সে সময় ক্রিশ্চিয়ান সায়েন্স মনিটরে প্রকাশিত প্রতিবেদন থেকে জানা যায় যে, কিকটেভ ছিলেন কেজিবির একজন দক্ষ ও ক্রর কর্মকর্তা। গাহিজ হত্যার পর মুসলিম দেশগুলো একত্রে ওই ঘটনার তীব্র নিন্দা জানালে ও সোভিয়েত ইউনিয়নকে সতর্ক করে দিলে সাময়িকভাবে তাদের তৎপরতা কিছুটা হ্রাস পায়।

কেজিবি শুধু একজন সাংবাদিক গাহিজকেই হত্যা করেনি। তাদের মাত্রাতিরিক্ত অপতৎপরতার জন্য অনেক দেশকেই বছরের পর বছর মারাত্মক খেসারত দিতে হয়েছে। বিশেষ করে আফগানিস্তানে সোভিয়েত আগ্রাসনের রেশ ধরে আজ পুরো পৃথিবীতেই ধর্মীয় উগ্রতার বিষবাষ্প ছড়িয়ে পড়েছে। নিউটনের তৃতীয় সূত্রের মতে, প্রত্যেক ক্রিয়ার সমান ও বিপরীত প্রতিক্রিয়া রয়েছে। সেই সূত্র অনুযায়ী, আফগানিস্তানে জোর করে সংস্কৃতি, সমাজ পরিবর্তন করতে গিয়ে সোভিয়েত ইউনিয়ন যে দানবীয় নাস্তিক্যবাদী, কথিত ধর্মনিরপেক্ষতাবাদী জঙ্গিবাদের সূচনা করে তার বিপরীতেই জন্ম নেয় ধর্মকেন্দ্রিক জঙ্গিবাদ।

সাংবাদিক গাহিজ হত্যার মতোই এক ভয়াবহ, ক্রুর কিন্তু প্রকাশ্য হত্যাকাণ্ড দিয়েই সোভিয়েত ইউনিয়ন ১৯৭৯ সালে আফগানিস্তানে তাদের আগ্রাসনের সূচনা করে। তখন আফগানিস্তানের প্রেসিডেন্ট ছিলেন হাফিজুল্লাহ আমিন। তিনি এর আগে ১৯৭৮ সালের ১৬ সেপ্টেম্বর প্রেসিডেন্ট নূর মোহাম্মদ তারাকির বিরুদ্ধে এক সামরিক অভ্যুত্থান সংঘটিত এবং ৮ অক্টোবর তাকে বালিশ চাপা দিয়ে হত্যা করেন। সামরিক বাহিনীর সহায়তায় দেশের ক্ষমতা দখল করে নিয়ে প্রেসিডেন্টের পদে আসীন হন তিনি। এই দু’জনই ছিলেন কট্টরবাদী কমিউনিস্ট দল-পিপলস ডেমোক্র্যাটিক পার্টি অব আফগানিস্তান-পিডিপিএ’র নেতা। আমিন এক সময় যুক্তরাষ্ট্রে লেখাপড়া করলেও গড়ে ওঠেন ভয়াবহ নিবর্তনবাদী পাঁড় কমিউনিস্ট হিসেবে। তার আমলে হাজার হাজার আফগানকে শুধু বিরোধী মতের বা কমিউনিস্ট বিরোধী প্রতিক্রিয়াশীল হিসেবে চিহ্নিত করে আফগান গোয়েন্দা সংস্থা- দি ন্যাশনাল ডিরেক্টরেট অব সিকিউরিটি (এনডিএস) হয় হত্যা করে, না হয় গুম করে দেয়। হত্যার শিকার কারো লাশ আজ পর্যন্ত পাওয়া যায়নি। আমিনের ‘অবসেশন’ ছিল কথিত ‘প্রগতিশীল’ জাতি গঠন যেখানে রাষ্ট্রীয়, সাংস্কৃতিক, সামাজিক জীবন-সব চলবে সোভিয়েত স্টাইলে। গ্রামাঞ্চলের পর্দানশিন মহিলাদের জোর করে বোরকা খুলে দেয়াসহ নানারূপ ‘তুঘলকি’ কারবার শুরু হয় আমিনের হাত দিয়ে। কাবুল ও বড় শহরগুলোয় কমিউনিস্ট মতাদর্শে বিশ্বাসী কিছু ছাত্রীর স্কার্ট পরে ঘোরার ছবি ফলাও করে মিডিয়ায় প্রকাশিত হলো। ধারণা দেয়ার চেষ্টা হয় যে, আফগানিস্তানে নারীদের ‘ব্যাপক অগ্রগতি’ হয়েছে! এসব ছিল সৈয়দ মুজতবা আলীর ‘দেশে বিদেশে’ বইয়ে উল্লিখিত বাদশাহ আমানুল্লাহর জোর করে আফগানদের কোট টাই পরানোর উদ্যোগের মতো। মুজতবা আলীর ভাষায়, ওইসব সাহেবি পোশাককে আফগানরা ‘দেরেশী’ হিসেবে ব্যঙ্গ করা শুরু করে। দেখা যেতে থাকে কারো গলায় ঝুলছে টাই নামের চিকন কাপড়, প্যান্ট উঠে গেছে হাঁটুর কাছে, কোটের কোনো আগামাথা নেই! আমানুল্লাহর কাছে এটাই ছিলো বিশাল অ্যাচিভমেন্ট। এসব চটকদার স্ট্যান্টবাজিতে চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে ক্ষোভ। এরই সুযোগ নেয় ডাকাত বাচ্চায়ে সকাও। এসব ছিল সেই ১৯২৯ সালের কথা।

হাফিজুল্লাহ আমিনও জোর করে আফগানদের কমিউনিস্ট বানাতে চেয়েছিলেন। আমিন তার এসব নিবর্তনমূলক কাজ বৈধ করার জন্য প্রায়ই বলতেন, ‘Comrade Stalin showed us how to build socialism in a backward country.’ অর্থাৎ, ‘কমরেড স্ট্যালিন আমাদের শিখিয়েছেন কিভাবে একটি পশ্চাৎপদ দেশে সাম্যবাদ দাঁড় করাতে হয়!’ বিরোধী মতকে রাষ্ট্রীয় সব সংস্থা দিয়ে নিপীড়ন করাকে তিনি মনে করতেন পশ্চাৎপদ সমাজকে এগিয়ে নেয়া, যেমনটি করেছিলেন স্ট্যালিন চার কোটির বেশি নিজ দেশের নাগরিক হত্যা করে।

আমিনের এসব হাস্যকর বর্বরতার বিরুদ্ধে দেশে চরম প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়। কিন্তু গোয়েন্দা সংস্থা ও সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রত্যক্ষ আশকারা থাকায় সাধারণ জনগণ অসহায় হয়ে পড়ে। চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে অসন্তোষ। এমনি সময়ে সোভিয়েত ক্ষমতাসীনরা আফগানিস্তানে সামরিক আগ্রাসন চালিয়ে পুরো দখল করে নেয়ার পরিকল্পনা আঁটেন। এসব টের পায় সিআইএ ও আইএসআই। তখন পাকিস্তান অতি গোপনে ১৯৫১ সালে তাদের মিলিটারি ডকট্রিনে অন্তর্ভুক্ত উত্তর-পূর্ব সীমান্ত প্রদেশ ও বালুচিস্তানে সম্ভাব্য সোভিয়েত আক্রমণের প্রেক্ষাপটে গেরিলা যুদ্ধের যে সিদ্ধান্ত নিয়েছিল তা কার্যকর করার উদ্যোগ নেয়। তারা সীমান্ত এলাকায় পশতুনদের বিশ্বস্ত অংশকে প্রশিক্ষণ দেয়া শুরু করে। সিআইএ এসে সাথে জোটে। তারা আফগানিস্তানে কমিউনিস্ট আগ্রাসন ও কৌশলগত পরিবর্তন মোকাবেলায় ‘মুজাহিদিন বাহিনী’ গড়ে তুলতে থাকে। সোভিয়েত ক্ষমতাসীন মহল এ পটভ‚মিতে ১৯৭৯ সালের ১২ ডিসেম্বর আফগানিস্তানে সামরিক আগ্রাসন পরিচালনায় আর দেরি করা যাবে না বলে সিদ্ধান্ত নেয়।

এক পর্যায়ে সোভিয়েত প্রতিরক্ষামন্ত্রী দিমিত্রি উস্তিনভ সংশ্লিষ্ট বাহিনীর প্রতি নির্দেশ জারি করে বলেন, ‘The state frontier of the Democratic Republic of Afghanistan is to be crossed on the ground and in the air by forces of the 40th Army and the Air Force at 1500 hrs on 25 December’. অর্থাৎ ২৫ ডিসেম্বরের বেলা ৩টার মধ্যে সোভিয়েত বাহিনী আফগানিস্তানে আগ্রাসন চালাবে।

হাফিজুল্লাহ আমিনকে ওই সময় সোভিয়েতদের মূল উদ্দেশ্য যে আফগানিস্তানে দখলদারিত্ব কায়েম করে পাকিস্তানের বালুচিস্তান দখল করা সে সম্পর্কে একটি গোপন রিপোর্ট দিয়েছিল আফগান গুপ্তচর সংস্থা। কিন্তু অন্যান্য একনায়ক কমিউনিস্টের মতো আমিন সেই রিপোর্টকে মোটেই গুরুত্ব দেননি। বরং তিনি বলেছিলেন, সোভিয়েতরা তার সরকারকে সহায়তা ও আফগানিস্তানকে একটি প্রগতিশীল রাষ্ট্রে পরিণত করতে আসছে সাময়িকভাবে। তার পরও তিনি প্রেসিডেন্টের প্রাসাদ ত্যাগ করে ২০ ডিসেম্বর কঠোর নিরাপত্তা বেষ্টনী সমৃদ্ধ তাজবেগ প্রাসাদে চলে যান। সেখানে মোতায়েন করা হয় আড়াই হাজার সশস্ত্র সেনা ও কয়েকটি ট্যাংক। এর মাঝে কেজিবি ১৩ ডিসেম্বর স্নাইপারের মাধ্যমে গুলি করে আমিনকে হত্যার পরিকল্পনা আঁটে। অলৌকিকভাবে আমিন বেঁচে যান। তিনি উল্টো মনে করেন যে, সিআইএ তাকে হত্যার চেষ্টা করেছে!

চার দিকে আশঙ্কা, অনিশ্চয়তার মধ্যে ২৫ ডিসেম্বর সোভিয়েত বাহিনী আফগানিস্তানে প্রবেশ করে আফগান সেনাবাহিনীর প্রত্যক্ষ সহায়তায়। ১৯৭৮ সালে দুই দেশের মধ্যে স্বাক্ষরিত ‘বিশ বছর মেয়াদি মৈত্রী ও বন্ধুত্ব চুক্তি’র আওতায় শুরু হয় ওই আগ্রাসন। কাবুল বিমানবন্দরে একের পর এক বিশালাকৃতির সামরিক পরিবহন বিমান নামতে থাকে। সীমান্ত দিয়ে প্রবেশ করে ট্যাংক, সাঁজোয়া যান, ভারী কামানসহ হাজার হাজার মিলিটারি যান। প্রায় এক লাখ সৈন্যের বিশাল সোভিয়েত বাহিনী অবস্থান নেয় আফগানিস্তানের কৌশলগত স্থানগুলোতে।

২৭ ডিসেম্বর দুপুরে তাজবেগ প্রাসাদে লাঞ্চ পার্টি দেন আমিন। সেখানে বাবুর্চি বেশে কর্মরত এক কেজিবি এজেন্ট স্যুপে বিষ প্রয়োগ করে আবারো আমিনকে হত্যার চেষ্টা চালান। আমিন অজ্ঞান হয়ে পড়েন। কিন্তু এবারো বেঁচে যান। এরপর কেজিবি ও সোভিয়েত বিশেষ বাহিনী তাদের দ্বিতীয় পরিকল্পনা ‘অপারেশন স্টর্ম-৩৩৩’ শুরু করে। তারা ঝটিকা আক্রমণে প্রেসিডেন্টের তাজবেগ প্রাসাদে প্রবেশ করে তাকে সপরিবারে হত্যা করে। তার একটি মাত্র মেয়ে ছাড়া বাকি প্রায় ডজন দুয়েক পুত্রকন্যাকে হত্যা করা হয়। পরদিন সোভিয়েত ও আফগান মিডিয়ায় আমিনকে সিআইএ’র অনুপ্রবেশকারী ও কমিউনিজমের শত্রæ বলে বিষোদগার করা হয়। বলা হয়, ‘আফগানিস্তানে নতুন সূর্য উঠেছে, প্রগতির ধারায় এগিয়ে যাওয়ার পথ প্রশস্ত হয়েছে!’ ক্ষমতায় বসানো হয় আরেক সোভিয়েত পুতুল বাবরাক কারমালকে।

এভাবেই নির্মমতা, ছলনা, সামরিক শক্তি, ভণ্ডামির মাধ্যমে শুরু হয় দশ বছর মেয়াদি ইতিহাসের ভয়াবহতম ক্রুর এক সামরিক দখলদারিত্বের। অঘটনের সেই শুরু। লাখ লাখ স্বাধীনচেতা আফগানকে হত্যা করে দখলদার সোভিয়েত বাহিনী ও তাদের আফগান দোসর কমিউনিস্ট পেটোয়া বাহিনী। প্রায় পঞ্চাশ লাখ আফগান সোভিয়েত আগ্রাসনের হাত থেকে জীবন, মান-সম্ভ্রম বাঁচাতে আশ্রয় নেয় পাকিস্তান ও ইরানে। অনেকে চলে যায় পশ্চিমা দেশগুলোতে। ওই দশটি বছর মুজাহিদিন ও কথিত প্রতিক্রিয়াশীল চক্র দমনের নামে প্রায় বিশ লাখ আফগানকে হত্যা করা হয়। লাখ লাখ পঙ্গু হয়ে যায়। গ্রামের পর গ্রাম আকাশপথে হামলা হেলিকপ্টার দিয়ে এবং স্থলপথে ট্যাংক-সাঁজোয়া যান দিয়ে গুঁড়িয়ে দেয়া হয়। এমনকি সীমান্ত অতিক্রম করে আশ্রয় নেয়া আফগানদের ত্রাণ শিবিরগুলোতে হামলা চালানো হয় জঙ্গিবিমান দিয়ে। নাপাম বোমা দিয়ে পুড়িয়ে মারা হয় শরণার্থীদের। ১৯৮৮ সালের ৮ আগস্ট রাতে এমনি এক মিশনে এসইউ-২৫ যুদ্ধবিমান নিয়ে পাকিস্তানের অভ্যন্তরে মারানশাহ শরণার্থী শিবিরে নাপাম বোমা বর্ষণ করতে আসেন সোভিয়েত কর্নেল রুতস্কয়। কিন্তু পাক বিমানবাহিনীর জঙ্গিবিমান তার বিমানটি ধ্বংস করলে রুতস্কয় প্যারাসুটের মাধ্যমে পাকিস্তানের মাটিতে অবতরণ করতে বাধ্য হন। তাকে গ্রেফতার করে পাক সরকার। বহু দেনদরবারের পর রুতস্কয়কে ছেড়ে দেয়া হয়। পরে সোভিয়েতের পতন হলে কর্নেল রুতস্কয় রাশিয়ার ভাইস প্রেসিডেন্ট হয়েছিলেন। ওই সময় একটি চরম মানবতাবিরোধী বিষয় পৃথিবীর দৃষ্টি কেড়েছিল। সোভিয়েত বাহিনী ছোট বাচ্চাদের হত্যা বা মারাত্মকভাবে জখম করার জন্য বিভিন্ন ধরনের খেলনা সামগ্রী রাতের বেলা আকাশ থেকে আফগানিস্তানের গ্রাম এলাকায় নিক্ষেপ করত। বাচ্চারা ওইসব দেখে খেলতে গিয়ে মারা পড়ত। এ জাতীয় মানবতাবিরোধী নির্যাতনের বেশির ভাগই আবার কঠোর প্রেস সেন্সরশিপের কারণে বাইরে প্রকাশিত হতো না। আজ এত বছর পর বিশ্ব সেসব ভুলতে বসেছে। ভুলে গেছে অপরাধের সূত্রপাত সোভিয়েত ইউনিয়ন শুরু করেছিল। ওই আগ্রাসনের প্রতিক্রিয়াতেই জন্ম নিয়েছিল মুজাহিদিন যা পরে উগ্রবাদী বিভিন্ন সংগঠনে রূপ নেয়।

সোভিয়েত আগ্রাসন মোকাবেলায় মুজাহিদিনদের প্রশিক্ষণ ও অস্ত্র দেয় আমেরিকাসহ সব পশ্চিমা শক্তি, মুসলিম দেশ ও চীন। পাকিস্তানে গড়ে ওঠে প্রশিক্ষণ শিবির। আমেরিকা সোভিয়েত বিমানবাহিনীর অত্যাধুনিক জঙ্গিবিমানের অব্যাহত হামলা ঠেকাতে পাকিস্তানকে সরবরাহ করে এফ-১৬ যুদ্ধবিমান। মুজাহিদিনদের দেয় কাঁধে বহনযোগ্য বিমানবিধ্বংসী স্টিঙ্গার মিসাইল। কথিত আছে যে, মার্কিন অনুরোধে সেসময় সৌদি বাদশাহ পুরো মুসলিম বিশ্বে জিহাদের ডাক দেন স্রষ্টায় অবিশ্বাসী সোভিয়েতদের বিরুদ্ধে। মূলত সেই আহ্বানের কারণেই প্রায় সব মুসলিম দেশ থেকে হাজারে হাজারে গেরিলা যোগ দেয় সোভিয়েতবিরোধী যুদ্ধে। সে সময় সেখানে এসে হাজির হন ‘ভবিষ্যতের সন্ত্রাসী’ ওসামা বিন লাদেন ও আয়মান আল জাওয়াহিরি। তারা তখন সবাই ছিলেন পশ্চিমাদের ‘সুইটহাটর্’। খ্রিষ্টান জগৎ, ইহুদি রাষ্ট্র ইসরাইল- সবাই সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের জন্য এক হয়ে মুসলমানদের সাথে গাঁটছড়া বেঁধেছিল। গণতান্ত্রিক দেশগুলোর মধ্যে একমাত্র ভারত পক্ষ নিয়েছিল সোভিয়েত ইউনিয়নের। বাংলাদেশের মস্কোপন্থী কমিউনিস্টরাও তাদের পদাঙ্ক অনুসরণ করেন।

এদিকে আফগান ঝড়ের প্রায় পুরোটাই সামলাতে হয়েছিল পাকিস্তানকে। লাখ লাখ আফগান শরণার্থী, মুজাহিদিনদের প্রশিক্ষণ, সহায়তা প্রদান, লজিস্টিকস নিশ্চিত করাসহ সব ভার বহন করেছে পাকিস্তান। এতে পাকিস্তানের পুরো সমাজে বিষবৃক্ষের রোপণ প্রক্রিয়াও সম্পন্ন হয়। শরণার্থীদের সঙ্গে লুকিয়ে প্রবেশ করে আফগান গুপ্তচর সংস্থার অপারেটিভরা। তারা পাকিস্তানে সন্ত্রাসী তৎপরতার তাণ্ডব শুরু করে। সেই থেকে পাকিস্তানে জেঁকে বসে উগ্রবাদ, সংস্কৃতিতে আসে পরিবর্তন। অনিবন্ধিত মাদরাসার সংখ্যা আনাচে কানাচে বৃদ্ধি পায় যেগুলোতে সরকারের কোনো নিয়ন্ত্রণ ছিল না, এখনো নেই। এগুলো থেকেই বের হতে থাকে বিশ্ব সম্পর্কে খুবই কম জানা, ‘মাথা গরম’ উগ্রবাদী গোষ্ঠী যারা নিজ দেশের সামরিক বাহিনীকেও ‘অমুসলিম’ বলে মনে করে থাকে, আত্মঘাতী বোমা হামলাকে ‘ধর্মীয় রাষ্ট্র কায়েমের পথ’ বলে বিশ্বাস করে। এর রেশ চলছে চার দিকে। এর মূল দায় অবশ্যই সোভিয়েতদের, কমিউনিজম কায়েমের সেই খায়েশের। বলা যায়, কমিউনিজমের ধর্মবিরোধী জঙ্গিবাদই ধর্মভিত্তিক জঙ্গিবাদকে ডেকে এনেছে, নিউটনের তৃতীয় সূত্রের স্বাভাবিক নিয়মে।

সমাজতন্ত্রের নামে যে ভয়াবহ অত্যাচার, নিপীড়ন চালানো হয় আফগানিস্তানে, তা আজ অনেকটাই ধামাচাপা পড়ে গেছে। এখনকার প্রজন্ম তো বলতে গেলে এ নিয়ে কিছুই জানে না। অন্যরাও বিষয়টি প্রায় ভুলতে বসেছে। কারণ, ১৯৮৯ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি সোভিয়েত বাহিনী পরাজয়ের কালিমা নিয়ে আফগানিস্তান থেকে চলে যাওয়ার পর ১৯৯১ সালের ডিসেম্বরে সোভিয়েত রাজত্বের পতন হয় ও দেশটি টুকরো টুকরো হয়ে যায়। পূর্ব ইউরোপের দেশে দেশেও কমিউনিজম জাদুঘরে স্থান পায়। তখন সাবেক মস্কোপন্থী কমিউনিস্টরা খোলস বদলিয়ে পশ্চিমা দেশগুলোসহ বিশ্বের প্রায় সব দেশেই সমাজের সব ক্ষেত্রে অনুপ্রবেশ করে। পশ্চিমাদের তারা এমন একটি ধারণা দেয় যে, মুসলমানরা হলো পরবর্তী সমস্যা ও তাদের নিয়ন্ত্রণে রাখতে হলে এক্স কমিউনিস্টরাই সেরা হাতিয়ার! দেখা যায় সব দেশে, বিশেষ করে মুসলিম দেশগুলোতে মিডিয়া, এনজিও দখল করে বসেছে সাবেক মস্কোপন্থী কমিউনিস্টরা। এরা মিষ্টি মিষ্টি কথায় কতগুলো শব্দ ছুড়ে দেয় সমাজে। লিঙ্গ বৈষম্য, নারীর ক্ষমতায়ন এদের খুব পছন্দের শব্দ। বাস্তবে এসবে তারা কতটুকু বিশ্বাস করে তা গবেষণার বিষয়। তবে এরা সাফল্যের সাথে সব জায়গায় রিপারকেশন বা প্রতিক্রিয়া সৃষ্টিতে সক্ষম হয়। এরাই প্রচারমাধ্যম ও বিভিন্ন সংগঠনকে কাজে লাগিয়ে আফগানিস্তানে সোভিয়েত আগ্রাসনের ইতিহাসটা আড়াল করেছে। এদের কাজের মধ্য দিয়েই প্রতিটি মুসলিম দেশে সৃষ্টি হয়েছে প্রতিক্রিয়াশীল জঙ্গিবাদের। খেসারত দিচ্ছে গণতান্ত্রিক বিশ্ব ও মুসলমানরা। এক দিকে লুকানো সমাজতান্ত্রিক ধাঁচের অতি ধর্মনিরপেক্ষ জঙ্গিবাদ, অপর দিকে ধর্মীয় জঙ্গিবাদ। এটাই ওদের প্রতিশোধ আফগান যুদ্ধে তাদের স্বপ্নের কমিউনিস্ট স্বর্গ ভেঙে ছত্রখান হয়ে যাওয়ার।

শক্তিমান বিধাতা লিওনিদ ব্রেজনেভ অ্যান্ড গংকে ক্ষমা করেননি। হয়তো অন্যদেরও ক্ষমা করবেন না। কারণ সবাই কেবল কৌশলগত কারণে, মানবিকতার জন্য নয়, আফগানিস্তানে আগ্রাসন চালিয়েছে এবং এখনো জ্বলছে পৃথিবীর অগণিত দেশ।

মূল উপসম্পাদকিয়-টি দৈনিক নয়াদিগন্ত-এর ২১ সেপ্টেম্বর ২০২১ প্রকাশ করা হয়েছিল।

মূল লিঙ্কঃ ইতিহাসের ভুলে যাওয়া অধ্যায় : আফগানিস্তানে সোভিয়েত আগ্রাসন

Abu Rushd, Editor in Chief, Bangladesh Defence Journal
Editor in Chief at Bangladesh Defence Journal | Website |  + posts

Abu Rushd, the President of the Institute of Strategy and Tactics Research (ISTR), is a towering figure whose unparalleled experience spans military service, defense journalism, and global intelligence analysis. A former military officer turned investigative journalist, Abu Rushd brings over three decades of expertise in national security, international relations, and defense intelligence, making him an authoritative voice in shaping strategic discourse on global security challenges.

As a pioneer of defense journalism in Bangladesh, Abu Rushd has continuously pushed the boundaries of investigative reporting. He introduced defense and intelligence coverage into Bangladeshi media and established the Bangladesh Defence Journal, the country’s only publication dedicated to these critical issues. His in-depth understanding of intelligence agencies, military operations, and insurgency conflicts is reflected in his eight widely acclaimed books, with works cataloged in prestigious institutions like the University of Chicago, Yale University, and the University of Toronto.

Rushd's fearless journalism has taken him from the conflict zones of Sierra Leone to the reconstruction efforts in South Sudan. He has served as an official media partner at global defense expos, providing high-level analysis and insights into international security operations. His work on intelligence agencies, including his influential book on Indian espionage RAW in Bangladesh, stands as a testament to his commitment to uncovering hidden geopolitical forces.

As the President of ISTR, Lt. Abu Rushd's leadership reflects a rare combination of military precision, investigative rigor, and intellectual boldness. His visionary approach is essential for advancing strategic research that influences policy and shapes the future of global security.

Popular

Latest